সর্বশেষ

পবিত্র শবে বরাতের আমল ও ইবাদত

120
Before post box 1
অধ্যক্ষ এম সোলাইমান কাসেমী :: আরবি মাসসমূহের মধ্যে অষ্টম মাস হলো শা’বান। এ মাসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাসূলে করিম (সা.) এ মাসে যত বেশি পরিমাণ রোযা রাখতেন, যা রমজান ব্যতীত অন্য কোন মাসে রাখতেন না। এ জন্য মাহে শা’বানে বেশি পরিমাণে রোযা রাখা মুস্তাহাব। মাহে শা’বানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত হচ্ছে পবিত্র শবেবরাত। যা বিশেষ ফজিলতময় রাত্রি। শবে বরাত ফার্সি শব্দ। শব অর্থ রাত আর বরাত অর্থ মুক্তি। অর্থাৎ এ রাতে ইবাদত-বন্দেগি ও তাওবার দ্বারা গুনাহ থেকে মুক্তি লাভ হয়। 
 মহান আল্লাহ তায়ালা নিজ বান্দাদের ওপর দয়া ও ক্ষমার কেবল অসিলা তালাশ করেন, যে কোনো পথেই হোক ক্ষমা করার বাহানা খোঁজেন। তাই দয়াময় আল্লাহ তায়ালা তাঁর গুনাহগার বান্দাদের ক্ষমা করার জন্য বিভিন্ন স্থান ও সময়-সুযোগ বাতলে দিয়েছেন, যাতে বান্দা নিজ কৃতকর্মে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চায়, আর আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করে দেবেন।
আমাদের বর্তমান সমাজে মানুষ এ রাত নিয়ে অনেক প্রান্তিকতার শিকার। একটি দল তা পালনে এ পরিমাণ বাড়াবাড়ি করে যে মসজিদ ও বাড়ি-ঘরে আলোকসজ্জা, কবরে পুষ্প অর্পণ, আতশবাজি, হালুয়া-রুটি ও মিষ্টি বিতরণকেই এ রাতের আমল বানিয়ে নিয়েছেন।
ইসলামি‌ শরিয়তে এ ধরনের কুসংস্কারের কোনো ভিত্তি নেই।  পক্ষান্তরে এর সম্পূর্ণ বিপরীতে একটি দল উপরোক্ত ভ্রান্ত কাজকর্মের বিরোধিতা করতে গিয়ে শবে বরাতের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে বসেছেন এবং তারা এ রাতের কোনো বৈশিষ্ট্যই মানে না; বরং এ রাতের সব কিছুকেই বিদআত বলে থাকে।
অপরদিকে  ছেলে-মেয়েরা বাড়ি-ঘরে এ রাতে অনর্থক মোমবাতি জ্বালায়,অনেকে আতশবাজি ও বোমাবাজি করে। এ সবকিছুই সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও গর্হিত কাজ।
বাস্তবে এ দলটিও ভ্রষ্টতায় রয়েছে, কেননা শরিয়তে ওইসব কুসংস্কারের কোনো ভিত্তি না থাকলেও শবে বরাতের একাধিক ফজিলত, তাৎপর্য ও বিভিন্ন করণীয় কোরআনে করিম ও সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।  নিম্নে অতি সংক্ষেপে এর বিবরণ পেশ করা হলো।
ক্ষমা ও রহমতের রাত শবে বরাত : হজরত মু’আজ ইবনে জাবাল (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, অর্ধ-শাবানের রাতে অর্থাৎ শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিকুলের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও হিংসুক-বিদ্বেষী লোক ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।  (সহিহ ইবনে হিব্বান, হা. ৫৬৬৫, আল মু’জামুল কাবীর ২০/১০৯, শুআবুল ইমান, হা. ৬৬২৮)।
অষ্টম শতাব্দীর যুগশ্রেষ্ঠ হাদিস বিশারদ আল্লামা নূরুদ্দীন হাইসামি (রহ.) বলেন, হাদিসটির সূত্রের সব বর্ণনাকারী ‘নির্ভরযোগ্য’।  (মাজমাউজ জাওয়াইদ ৮/৬৫)।
এছাড়া এ মর্মে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.), হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রা.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.), হযরত আবু মুসা আশআরি (রা.), হযরত আবু হুরাইরা (রা.), হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) প্রমুখ সাহাবি থেকেও হাদিস বর্ণিত হয়েছে।
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, এক রাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) উঠে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন, এতে এত দীর্ঘ সময় ধরে সিজদা করলেন যে আমার ভয় হলো তিনি মারাই গেছেন কি না।  এ চিন্তা করে আমি বিছানা থেকে উঠে রাসুল (সা.)-এর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিই, এতে আমার বিশ্বাস হলো তিনি জীবিত আছেন।
তারপর নিজ বিছানায় ফিরে এলাম।  এরপর তিনি সিজদা থেকে মাথা ওঠালেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা সিদ্দিকা! তোমার কি ধারণা হয়েছে যে নবী তোমার সঙ্গে সীমা লঙ্ঘন করেছে? আমি বলি, জি না, হে আল্লাহর রাসুল! তবে আপনার দীর্ঘ সময় ধরে সিজদার কারণে আমার মনে হয়েছে আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন।
এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে আয়েশা! তুমি কি জানো, আজকের এ রাতটি কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল এ বিষয়ে অধিক জ্ঞাত।  রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, এ রাতটি অর্ধ শাবানের রাত।  এ রাতে আল্লাহ তায়ালা নিজ বান্দাদের প্রতি বিশেষ করুণার দৃষ্টি দেন, অনুগ্রহপ্রার্থীদের দয়া করেন।  তবে হিংসুক লোকদের তার অবস্থার ওপর ছেড়ে দেন।  (শুআবুল ইমান, হা. ৩৮৩৫)।  যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম বায়হাকি (রহ.) বলেন, এটি উত্তম মুরসাল হাদিস। (শুআবুল ইমান ৩/৩৮৩)।
শবে বরাতে রাত জেগে ইবাদত করা ও পরদিন রোজা রাখা : হজরত আলী (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘১৫ শাবানের রাত যখন হয়, তোমরা রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে পালন করো এবং দিনের বেলা রোজা রাখো।  কেননা এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে এসে বলেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব।
কোনো রিজিক অন্বেষণকারী আছে কি? আমি তাকে রিজিক প্রদান করব। আছে কি কোনো রোগাক্রান্ত? আমি তাকে আরোগ্য দান করব।  এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে তাদের ডাকতে থাকেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হা. ১৩৮৮)।
হাদিস বিশারদগণের গবেষণা মতে, এ হাদিসের সব বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য। তবে এতে শুধু ইবনে আবি সাবরা নামের এক ব্যক্তি রয়েছেন, তাঁর স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার কারণে হাদিসটি সামান্য দুর্বল বলে গণ্য হবে।  আর এ ধরনের দুর্বল হাদিস ফাজায়েলের ক্ষেত্রে সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণযোগ্য।
এছাড়া শবে বরাত সম্পর্কীয় হাদিসগুলোকে যুগশ্রেষ্ঠ হাদিসবিশারদ ইমামগণ সমষ্টিগতভাবে ‘সহিহ’ বা বিশুদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন, যাঁদের মধ্যে ইমাম ইবনে হিব্বান, হাফেজ ইবনে রজব হাম্বলি, হাফেজ ইবনে তাইমিয়া (রহ.) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
বছরব্যাপী ভাগ্যনির্ধারণের রজনী শবে বরাত : আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি বরকতময় রাতে।  নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী।  এই রাতে হেকমতপূর্ণ সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত করা হয়।’ (সুরা দুখান, আয়াত ২-৩) কোরআনের ব্যাখ্যাকারদের অনেকে আয়াতে উল্লিখিত ‘লাইল’ থেকে শবেকদর উদ্দেশ্য বললেও কয়েকজন ব্যাখ্যাকার এর অর্থ শবেবরাত বলেছেন।
এ ব্যাপারে ইকরামা (রহ.) সূত্রে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা অর্ধশাবানের রাতে যাবতীয় সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত ফয়সালা করেন। আর শবে কদরে তা নির্দিষ্ট দায়িত্বশীলদের অর্পণ করেন।  (তাফসিরে কুরতুবি ১৬/১২৬)।
হযরত আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, অর্ধশাবানের রাতের কার্যক্রম হলো, এ বছর যারা জন্মগ্রহণ করবে এবং যারা মারা যাবে তা লিপিবদ্ধ করা হয়।  এ রাতেই মানুষের আমল পৌঁছানো হয়। এতেই তাদের রিজিকের বাজেট করা হয়।  (ফাজায়েলে আওক্বাত, বায়হাকি, হা. ২৬)।
তাই এ রাতে তসবিহ-তাহলিল, ইসতিগফার, কোরআন তেলাওয়াত বেশি বেশি করতে হবে।  বিনয়ের সহিত আল্লাহর কাছে নিজের প্রয়োজনের কথা বলতে হবে।  এছাড়া উমরি কাজা ও নফল নামাজ অধিক পরিমাণে পড়তে হবে।  তবে শবে বরাতের নির্দিষ্ট কোনো নামাজ নেই।  হাজারিকা নামাজ বলতে ইসলামে কিছু নেই।  এটি বেদআত।  এ রাতে কবর জিয়ারতের বিশেষ ফজিলত রয়েছে।  আল্লাহ আমাদের নেক আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : অধ্যক্ষ এম সোলাইমান কাসেমী, 
পিএইচডি গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
after post box 2