সর্বশেষ

ডায়াবেটিস রোগীদের বন্ধু ডা. ডি.সি রায়

145
Before post box 1

 

নিউজ ডেস্ক:: আজ (১৫ নভেম্বর) সকাল ১০টা। দিনাজপুরের বীরগঞ্জ ডায়াবেটিস অ্যান্ড ফুট কেয়ার সেন্টারে গিয়ে দেখা গেলো, সারি করে সাজানো চেয়ারে শতাধিক নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ বসা। সামনে সাদা বোর্ডে লিখে এবং হাতে মাউথ স্পিকার নিয়ে কথা বলে তাদের বোঝাচ্ছেন এক ব্যক্তি। প্রথমে দেখে মনে হতে পারে বয়স্ক শিক্ষা কিংবা গণশিক্ষার কার্যক্রম চলছে। কিন্তু আসলে তা নয়, ডায়াবেটিস রোগীদের চলাফেরা, জীবনযাপন, রোগের প্রাদুর্ভাব ও প্রতিরোধের কৌশল শেখানোর মাধ্যমে এই রোগ এবং জটিলতা প্রতিরোধের উপায় বোঝাচ্ছেন ডা. ডি সি রায়। প্রচলিত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় শিক্ষা বা পাঠদানের মতো করে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার এমন ব্যতিক্রমী দৃশ্য সাধারণত দেখা যায় না। কিন্তু ডি সি রায়ের সেন্টারে সপ্তাহে রবিবার ও বৃহস্পতিবার সকালে এ দৃশ্য দেখা যায়। ডি সি রায়ের পুরো নাম দুলাল কৃষ্ণ রায়। সবার কাছে তিনি ডা. ডি সি রায় নামেই পরিচিত। এলাকার লোকজন তাকে গরিবের ডাক্তার বলে ডাকেন। ডি সি রায় এভাবে চিকিৎসা দেওয়ার মাধ্যমে সবার বন্ধু হয়েছেন তা কিন্তু নয়। বরং সবার বন্ধু হয়েছেন উপকারী মানুষ হিসেবে। এই সেন্টারে সপ্তাহে দুই দিন ৫০০ থেকে ৭০০ রোগীকে চিকিৎসাসেবা দেন। কিন্তু কারও কাছ থেকে পরামর্শ কিংবা ব্যবস্থাপত্রের ফি নেন না। আবার তার এখানে ছোট ল্যাব স্থাপন করেছেন। যেখানে গরিব রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ৩০-৪০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়। অনেক গরিব রোগীর ওষুধ কেনার সামর্থ্য না থাকলে নিজেই ওষুধ কেনার টাকা দেন। তার কাছে যাওয়া-আসার জন্য ভ্যান ভাড়া বা রিকশা ভাড়া না থাকলে তাও দিয়ে দেন। এসব কারণে তিনি সবার প্রিয়। কেউ কেউ তাকে বাবা বলে সম্বোধন করেন, কেউ ডাকেন ছেলে। গত কয়েক বছরে ডি সি রায়ের নাম ও সুচিকিৎসার কথা ছড়িয়ে পড়েছে সবার মাঝে। ফলে সপ্তাহের এই দুই দিন থাকে রোগীদের উপচে পড়া ভিড়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এখানে রোগীরা সেবা গ্রহণ করেন বিনামূল্যে।

এলাকার লোকজন তাকে গরিবের ডাক্তার বলে ডাকেন
ডি সি রায় সপ্তাহে দুই দিন এখানে রোগীদের সেবা দিলেও বাকি পাঁচ দিনের মধ্যে দুই দিন বসেন শহরের নিজ বাড়িতে। তিন দিন বসেন বেসরকারি একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে।
সরেজমিনে ডা. ডি সি রায়ের প্রতিষ্ঠান ডায়াবেটিস অ্যান্ড ফুট কেয়ার সেন্টারে গিয়ে জানা গেছে, এখানে নীলফামারী, পঞ্চগড় এবং বীরগঞ্জ, খানসামা, কাহারোল উপজেলা থেকে রোগীরা আসেন। শুধুমাত্র রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যই নির্ধারিত ফি দেন রোগী ও স্বজনরা। কিন্তু প্রয়োজনীয় পরামর্শ কিংবা ব্যবস্থাপত্র দেওয়ার জন্য ডি সি রায় ফি নেন না। রোগী ও স্বজনরা বলছেন, ভালো পরামর্শ, বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান এবং মাঝেমধ্যে গরিব মানুষকে সহয়তা করায় চিকিৎসা পেতে সহজ হচ্ছে তাদের। অনেক সময় বিনামূল্যে ওষুধ দেন। এজন্য সবাই ডি সি রায়ের কাছে আসেন। বীরগঞ্জ উপজেলার গোলাপগঞ্জ এলাকার নির্মলা দাসের বয়স ৬০ বছর। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন অনেক আগেই। চিকিৎসা নিতে দিনাজপুর জেলা শহরের চিকিৎসকদের কাছে যেতেন। এখন তিনি হাতের কাছেই পেয়েছেন ডি সি রায়কে। তার কাছে চিকিৎসা নিয়ে সন্তুষ্ট তিনি। নির্মলা দাস বলেন, ডি সি রায় অনেক ভালো মানুষ। আমার রোগের ব্যপারে তিনি অনেক কিছু বোঝান। ওষুধও বুঝিয়ে দেন। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে সচেতন করেন। আগে তো দিনাজপুর শহরের গিয়ে চিকিৎসা নিতাম। এখন হাতের কাছেই পাচ্ছি। যাতায়াতের জন্য হয়রানি হতে হচ্ছে না। পরামর্শ ও ব্যবস্থাপত্রের জন্য টাকা দিতে হয় না।

middle of post box 3

কাহারোল থেকে আসা আনিসুর রহমান বলেন, আমি ডি সি রায়ের কাছে ৫-৬ বছর ধরে চিকিৎসা নিচ্ছি। অনেক ভালো মানুষ। এখানে তিনি বিনামূল্যে চিকিৎসা দেন। আর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা কম খরচেই করা যায়। এই যুগে ডি সি রায়ের মতো ডা. পাওয়া মুশকিল। এজন্যই তাকে গরিবের ডা. বলা হয়। বীরগঞ্জ উপজেলার মরিচা গ্রামের ওসমান গণি বলেন, ডিসি রায়ের কাছে আজই প্রথম আসলাম। এসে দেখে তো অনেক ভালো লাগলো। উনি প্রথমে ক্লাসে অনেক পরামর্শ দিলেন। কি করা যাবে আবার কি করা যাবে না এসব। সবগুলো বিষয়ে তিনি অনেক ভালো পরামর্শ দিলেন। তারপরে তিনি রোগীদের একে একে দেখছেন। তবে সবচেয়ে ভালো দিক হলো পরামর্শ প্রদানের জন্য কোনও ফি নেন না। সবমিলিয়ে ডি সি রায়ের চিকিৎসাসেবা ভালো বুঝতে পারছি। বিলাশ চন্দ্র বিশ্বাস নামে এক রোগীর স্বজন বলেন, আমার রোগী ডায়াবেটিসে মারাই যাচ্ছিল। পরে ডি সি রায় আমার রোগীকে বাঁচিয়েছেন। রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে অনেক সুন্দর ব্যবহার করেন। রোগীদের সব কথাই তিনি শুনেন। এসবের জন্য রোগীর কাছ থেকে টাকাও নেন না। আগে দিনাজপুর শহরে যেতে হতো। এখন হাতের কাছে তাকে পাচ্ছি। যখন মন চায় তখনই আসি। অনেক সুবিধা পাচ্ছি। গরিব রোগীদের তিনি ফ্রি ওষুধ দেন। আমরাও পেয়েছি।

ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসার বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. ডি সি রায় বলেন, ডায়াবেটিস এমন রোগ যা কখনও নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যারা একবার এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের দুরবস্থা আমি দেখেছি। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিকভাবে তারা দুরবস্থার মধ্যে পড়ে যান। জীবনটাই তাদের কাছে অন্যরকম হয়ে যায়। গ্রামাঞ্চলের মানুষজন কম বিত্তশালী। গ্রামাঞ্চলের ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের ওষুধ ক্রয় ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেই অর্থনৈতিক দুরবস্থা সৃষ্টি হয়। সেইসঙ্গে চিকিৎসার প্রতি অনীহা দেখা দেয়। যাতে করে চিকিৎসার প্রতি তাদের অনীহা দূর হয় এবং সুস্থ থাকেন সেজন্য ফি ছাড়াই পরামর্শ দেওয়ার উদ্যোগ নিই। এখন অনেক রোগী আসেন যারা একসময় নিয়মিত আসতেন না। কিন্তু এই রোগ মানেই হলো নিয়মিত চেকআপ ও পরামর্শ গ্রহণ করা। প্রতিদিন ক্লাস বা সেমিনারে তাদের বোঝানোর উদ্দেশ্যে হলো, ডায়াবেটিস প্রাদুর্ভাব ও প্রতিরোধের কৌশল শিক্ষার মাধ্যমে এই রোগ ও জটিলতা প্রতিরোধ করা সম্ভব।

তিনি বলেন, আমি বীরগঞ্জেরই মানুষ। গত কয়েক বছর থেকেই ডায়াবেটিস রোগীদের কষ্ট অনুধাবন করেছি। দেখেছি গ্রামের তৃণমূল পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অর্থনৈতিক দুরবস্থায় পড়ে গেছেন। এই রোগ নির্মূল করা সম্ভব নয়। আজীবন চিকিৎসকের কাছে আসতে হয়। সে জায়গা থেকে আমি চিন্তা করেছি, যদি পরামর্শ ফি বিনামূল্যে দেওয়া যায় তাহলে তাদের অনেক উপকার হবে। ডা. টাকা নেন না বলে তারা এই রোগের ক্ষেত্রে সচেতন হবেন। এজন্যই পরামর্শ ফি নিই না।

ডি সি রায় আরও বলেন, বাংলাদেশে এখনও প্রায় এক কোটিরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আর এক কোটি মানুষ জানেই না যে তারা আক্রান্ত। অর্থাৎ অজান্তেই এই রোগ বহন করছেন। বিশ্বে যে হারে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, এখনই যদি আমরা মানুষকে সচেতন করতে না পারি তবে জাতীয় অর্থনীতিতে একটি বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হবে বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তাই সাধ্যমতো ডায়াবেটিস নিয়ে মানুষকে সচেতন করতে কাজ করে যাচ্ছি।

after post box 2