সর্বশেষ

ইউজ হার্ট ফর এভরি হার্ট

120
Before post box 1

 

নিউজ ডেস্ক :: আধুনিক জীবন হৃদয়বান্ধব নয়, বাড়ছে হৃদরোগ চিকিৎসাবিজ্ঞানে হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগকে বলা হয়ে থাকে ‘মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন’। করোনারি ধমনি হৃদযন্ত্রের যে অক্সিজেন সরবরাহ করে, সেটি বাধাপ্রাপ্ত হলে এই রোগটি দেখা দেয়। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অনিয়মিত জীবনযাপনসহ নানা কারণে ফ্যাট জমে সময়ের সঙ্গে এই অক্সিজেন সরবরাহ মারাত্মকভাবে কমে যায় এবং ফুসফুসে রক্ত সরবরাহও স্থবির হয়ে পড়ে। কার্ডিয়াক ইস্কেমিয়ার পরিস্থিতি তৈরি হলে হৃদযন্ত্রে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয় এবং তার চিকিৎসায় দেরি হলে হৃদযন্ত্রের কোষের মৃত্যু ঘটে। এর প্রভাবেই একজন মানুষ হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগে আক্রান্ত হন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি বহির্বিশ্বের পাশাপাশি দেশেও হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এবং এতে মৃত্যুর ঘটনা বেড়েছে। গড়ে প্রতি বছর এই রোগে আক্রান্ত হয়ে দেশে প্রায় ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ মারা যায়। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আজ বৃহস্পতিবার (২৯ সেপ্টম্বর) বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হবে ‘বিশ্ব হার্ট দিবস’। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘ইউজ হার্ট ফর এভরি হার্ট’।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ক্লিনিক্যাল রিসার্চের রেজিস্ট্রার ডা. শেখ মো. মাহবুবুস সোবহান বলেন, দেশে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত রোগী বৃদ্ধির একটি বড় কারণ হলো, প্রাপ্তবয়স্কদের মাঝে উচ্চ রক্তচাপের আধিক্য ২১ শতাংশ বেড়ে যাওয়া। এর ফলে প্রতি ৫ জনের একজন বর্তমানে এই সমস্যায় ভুগছেন। এমনকি উচ্চ রক্তচাপে ভোগা অনেকে বিষয়ট বুঝতেই পারছেন না অনেক সময়। ফলে যথাযথ চিকিৎসাও নেওয়া হচ্ছে না তাদের। এ কারণে একটা পর্যায়ে এসে হঠাৎ করেই হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হচ্ছে এবং অনেকের মৃত্যুও ঘটছে

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম এ বাকীও প্রায় একই রকম তথ্য দেন। এই দুই বিশেষজ্ঞের মতে, যেসব কারণে হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার। সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুল ইত্যাদিতে আসক্ত ব্যক্তিরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হন। বাংলাদেশে এই তামাক দ্রব্যের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়িয়েছে। ইদানীং বয়স্কদের তুলনায় তরুণরাও তামাকদ্রব্য বেশি ব্যবহার করায় পরিস্থিতির আরও অবণতি হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে ১৯ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয় তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারণে হওয়া হার্ট অ্যাটাকে। বাংলাদেশে হার্ট অ্যাটাকে প্রতি বছর যেসব রোগী মারা যান (২ লাখ ৭৭ হাজার জন), যাদের ২৪ শতাংশই তামাকের কারণে। গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্টাডির (জিবিডি) ২০১৯ সালের তথ্য বলছে, দেশে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের অন্যতম প্রধান কারণ হলো তামাক। বর্তমানে দেশের ৩ কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করছেন, যা শতাংশের হিসেবে ৩৫ দশমিক ৩।

এই ভয়াবহ পরিস্থিতি ঠেকাতে সম্প্রতি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আইনটির খসড়া সংশোধনীতে পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহনে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ বাতিল, বিক্রয়স্থলে তামাক দ্রব্য বা প্যাকেট প্রদর্শন নিষিদ্ধ, তামাক প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া নিষিদ্ধ, খুচরা বা খোলা তামাক দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে। খসড়াটি অংশীজনের মতামতের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে রাখা হয়েছে।

middle of post box 3

ডা. শেখ মো. মাহবুবুস সোবহানের মতে, হার্ট অ্যাটাকের অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, দ্রুত নগরায়ণের ফলে সমাজের একটি বড় অংশের ফাস্টফুড, জাংকফুড, চর্বিজাতীয় খাবার বেশি খাচ্ছেন। এর বিপরীতে শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়া কমে গেছে। সেই সঙ্গে নানা কারণে কায়িক পরিশ্রমও কমে গেছে। সেই সঙ্গে বায়ুদূষণসহ পরিবেশে বিভিন্ন ধরনের দূষণের মাত্রাও বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণেও হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা বেড়েছে।

ডা. এম এ বাকী বলছেন, ‘হার্ট অ্যাটাকে আগে হয়তো প্রবীণরা বেশি আক্রান্ত হতেন। এখন বিভিন্ন পরিবেশগত, খাদ্যাভ্যাসগত এবং অত্যধিক পরিশ্রমের কারণে তরুণদের ক্ষেত্রেও এটি হচ্ছে। এই রোগ এক দিনে হয় না, বরং করোনারি আর্টারি ডিজিসের ঝুঁকির কারণে হয়ে থাকে।’

তার মতে, প্রেসার, ডায়াবেটিস, ধূমপান, কোলেস্টেরল এবং জেনেটিক কারণেও হার্ট অ্যাকাট হয়ে থাকে। এর পেছনে রয়েছে, সেডেন্টারি জীবনযাপন, দৈহিক কাজ ও হাঁটাচলা কম করা ও ওজন বেড়ে যাওয়া। এক কথায় বললে, শহরের আধুনিক জীবন হৃদবান্ধব না হওয়ায় নগরবাসীর হার্ট অ্যাটাক বেড়েছে। ফলে ২৫-৩০ বছর বয়সেও এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন, যেটি আগে দেখা খুব একটা দেখা যেতো না।

এ ছাড়া হঠাৎ করে দেশে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্তের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে শারীরিকের পাশাপাশি মনো-দৈহিক কিছু কারণ আছে বলে মনে করেন সাইকোসোশ্যাল কাউন্সিলর সামিয়া আলম। তিনি বলছেন, কর্টিসোল হরমোনের আধিক্য এবং স্ট্রেস হরমোন হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। এখন মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি স্ট্রেসে থাকছে। এর পেছনে রয়েছে—কাজের চাপ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জীবনযাত্রার মানবৃদ্ধি, ভালো থাকার আকঙ্ক্ষা, আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি ও আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া প্রভৃতি।

তার মতে, মনো-দৈহিক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবের সাথে বাসায় আড্ডা এবং ভালো-মন্দ শেয়ারিং কমে যাওয়া, সেরেটোনিন হরমোন ও হ্যাপি হরমোন নিঃসরণ বাধাগ্রস্ত হওয়া, রেস্টুরেন্ট ব্যবস্থা ও অনলাইনে অভ্যস্ততা, প্রকৃতির কাছ থেকে দূরে চলে যাওয়া, প্রযুক্তি ও ডিভাইসনির্ভরতা বেড়ে যাওয়া, ‘কোয়ালিটি টাইম’ স্পেন্ড না হওয়া, সামাজিক মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তি আসক্তির পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া, রিলেশনের হারমনি নষ্ট হওয়া, পারিবারিক অশান্তি ও কলহ বেড়ে যাওয়া এবং মনো-দৈহিক সমস্যাগুলোর সমাধানে সচেষ্ট না হওয়া।

হার্ট অ্যাটাক হলে কীভাবে বুঝবেন? চিকিৎসকরা বলছেন, বুক ব্যথা, মাথা ঘোরা, শ্বাস নিতে সমস্যা, ক্লান্তি, গ্যাস হওয়া ও ঘেমে যাওয়া এই রোগে আক্রান্তের অন্যতম লক্ষণ। এসব সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে যাওয়া এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলেছেন তারা।

চিকিৎসকরা বলছেন, প্রাত্যাহিক জীবনযাপনে ছোট কিছু পরিবর্তন এনে হৃদরোগ প্রতিরোধ সম্ভব। এসব পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে, খাদ্য তালিকায় স্বাস্থ্যকর খাবারের পরিমাণ বাড়ানো, দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন করা, শারীরিক পরিশ্রম বাড়ানো এবং ধূমপান ছেড়ে দেওয়া।

after post box 2