সর্বশেষ

মহানবী (সা.) সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য রহমত

98
Before post box 1

 

অধ্যক্ষ এম সোলাইমান কাসেমী :: মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপই প্রেরণ করেছি। (সুরা আম্বিয়া: আয়াত-১০৭) । মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রিয় নবী রাহমাতুল্লিল আলামীনের সুমহান নাম ও আলোচনা সমুন্নত করে দিয়েছেন। তিনি বলেন: ‘আর আমি আপনার স্মরণ ও আলোচনা উন্নত করেছি।’ (সুরা ইনশিরাহ : আয়াত-৪)।

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ নবী ও রাসূল। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাঁর অসাধারণ চরিত্র ও অনুপম ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি দিয়ে পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, “তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।” বিশ্বনবীর শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনা শুধুমাত্র কুরআন এবং মুসলমানরাই দেয়নি; বরং অমুসলিম মনীষীরাও দিয়েছেন। বিশ্বের অন্যতম অমুসলিম মনীষী ‘মাইকেল হার্ট’ রচিত বিশ্বের সর্বকালের সর্বাধিক প্রভাবশালী একশত মনীষীর জীবনীগ্রন্থে সর্বপ্রথম বিশ্বনবীর জীবনী রচনা করেছেন। এই গ্রন্থে তিনি মন্তব্য করেছেন, “মুহাম্মদ (সা.) -এর সাফল্যের মধ্যে জাগতিক ও ধর্মীয় উভয়বিধ প্রভাবের এক অতুলনীয় সংমিশ্রণ ঘটেছে। এজন্য সংগতভাবেই তাঁকে ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।” মহানবী (সা.) ছিলেন মানবজাতির অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় উত্তম চরিত্র ও মহানুভবতার একমাত্র আধার। তিনি ছিলেন একাধারে সমাজ সংস্কারক, ন্যায় বিচারক, বীরযোদ্ধা, যোগ্য রাষ্ট্রনায়ক, দক্ষ শাসক, এবং সফল ধর্মপ্রচারক। সকল ক্ষেত্রে মানবজাতির জন্য তিনি ছিলেন সর্বোত্তম আদর্শ। আমাদের উচিত, বিশ্বনবীর জীবনী বেশি বেশি অধ্যয়ন করা, তাঁর জীবনী নিয়ে আরো ব্যাপক গবেষণা করা। সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বিশ্বনবীর সুন্নাহ ও জীবনাদর্শের প্রতি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করা। সার্বিকভাবে মহানবী (সা.) -এর আদর্শ অনুসরণ-অণুকরণের মাধ্যমে বর্তমান সমাজের অধঃপতন অবণতি থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব।

middle of post box 3

আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ মক্কার কোরাইশ বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল্লাহ এবং মাতার নাম আমিনা। তাঁর জন্মের কয়েক মাস পূর্বেই পিতা আবদুল্লাহ মারা যান এবং শিশুকালেই তিনি তাঁর মাতৃ স্নেহ থেকে বঞ্চিত হন। মহান আল্লাহ তায়ালার কৃপায় কিছুদিন দাদা আবদুল মুত্তালিব এরপর চাচা আবু তালিবের স্নেহে লালিত পালিত হয়ে বেড়ে ওঠেন শিশু মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর জন্মের সময় আরবের অবস্থা ছিল খুবই ভয়াবহ। সে সময়ের মানুষ ছিল হানাহানি, রাহাজানি, সন্ত্রাস, ব্যভিচার-ধর্ষণ, খুন খারাবিতে মত্ত। তারা ভুলে গিয়েছিল মনুষ্যত্ব। অজ্ঞতা-মুর্খতার চরম পর্যায়ে পৌছে ছিল। সুশিক্ষার আলো হারিয়ে অন্ধকারের আবর্তে নিমজ্জিত হয়েছিল। যে কারণে সেই যুগকে ‘আইয়ামে জাহিলিয়াত’ বা জাহেলিয়াতের যুগ বলা হয়ে থাকে। বিশৃংখলা, অজ্ঞতা-মুর্খতা, অনাচার-পাপাচার করতে করতে তখনকার মানুষ একেবারে জাহান্নামের কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।মানবতার এই চরম দুঃসময়ে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) -কে আল্লাহ তায়ালা মুক্তির পথনির্দেশক মহাগ্রন্থ আল কুরআন দিয়ে জগতবাসীর জন্য রহমতস্বরুপ প্রেরণ করলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষকে সঠিক পথপ্রদর্শণ করলেন। জান্নাতের পথ দেখালেন।

শিশুকাল থেকে তিনি ছিলেন শান্ত, নম্রভদ্র ও সৎচরিত্রবান। সত্যবাদিতার কারণে সে সময়ের লোকেরা তাঁকে আল-আমীন উপাদিতে ভূষিত করেছিল। যুবককালে তিনি সমাজের কল্যাণে ব্রতী ছিলেন। সমসাময়িকদের সঙ্গী বানিয়ে তৎকালীন সময়ে ‘হিলফুল ফুজুল’ নামক একটি সমাজকল্যাণ সংস্থা গঠন করেছিলেন। এই সংস্থার মাধ্যমে সমাজে শন্তি প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ৪০ বছর বয়সে রাসূল (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে নবুওয়াত প্রাপ্ত হন। নবুওয়াত প্রাপ্তির পর তিনি মানুষকে কালেমার দাওয়াত দিতে লাগলেন। সর্বপ্রথম পরিজন ও নিকটজনদের মাঝে ঘোষণা করলেন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।” অর্থাৎ- “আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই, হযরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল।” মানুষকে বুঝালেন, এই কথাটি মুখে স্বীকার করা, অন্তরে বিশ্বাস করা এবং আল্লাহ তায়ালার বিধি-নিষেধ মেনে চলার মধ্যেই ইহ-পরকালীন সুখ-শান্তি নিহিত রয়েছে। এভাবে কালেমার বাণী প্রচার করে মানুষকে দ্বীনের পথে আহবান করতে লাগলেন।

রাসূল সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কালেমার বাণী প্রচারের সাথে সাথে নিকটজন ও ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যথেকে হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.)-সহ অনেকেই কোন রকম অজুহাত ব্যতিরেকে সানন্দে তা গ্রহণ করে নেন। মক্কার মুর্তিপূজক ও অগ্নিউপাসকদের চরম বিরোধিতা ও চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের মাঝেও মুসলমানদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। সুতরাং বর্তমান সময়ে যারা ইসলামের বিরোধীতা করেন, ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চান- তাদেরকে বলবো, আপনাদের এই মনোবাসনা কখনই পূর্ণ হবে না। আবু জেহেল, উতবা, সাইবা, উবাই, সুলূলরা পারেনি, আপনারাও পারবেন না। আপনারা যতই বিরোধিতা করবেন ইসলাম ততই প্রসারিত হবে। দ্রুত গতিতে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। দিকে দিকে ইসলামের বিজয়নিশান উড্ডীন হবে। এক দিকে আপনারা কুৎসা রটনা করছেন আর আরেক দিকে দ্রুততার সাথে মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত কয়েকদিনের পত্রিকায় শিরোনাম ছিলো- “দ্রুততার সাথে বাড়ছে ধর্মান্তরিত মুসলমানদের সংখ্যা।” সুতারং আপনাদের প্রতি বিনীত আহবান জানাচ্ছি, আপনারাও ইসলামের শাশ্বত বিধান গ্রহণ করুন। এক আল্লাহ’র বিশ্বাসে বিশ্বাসী হোন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) -কে আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসেবে মেনে নিন। যেনে রাখবেন, মুসলমানরা মহানবী (সাঃ) -কে নিজের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজনের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। রাসূল (সাঃ) -এর কটুক্তি ও অবমাননা করে রাসূলপ্রেমীদের হৃদয়ে আঘাত করা হয়েছে। আপনাদের জানা থাকা উচিৎ, কারো হৃদয়ে আঘাত করে নিজেরা সুখ-শান্তিতে থাকার আশা করা বোকামি। চামচিকার ভর্ৎসনা যেমনিভাবে সূর্যের আলো একটুও দমাতে পারে না, কুকুরের ঘেউ ঘেউ পূর্ণিমার চন্দ্রের স্নিগ্ধতার বিন্দুমাত্র ক্ষতি সাধন করতে পারে না; তেমনি আপনাদের নিন্দা ও কটুক্তির কারণে মহানবীর একটুও অপমান হবে না। বরং তাঁর শান-মান আরো বৃদ্ধি পাবে। ইসলামের জাগরণ সৃষ্টি হবে। নবীপ্রেমি জনতার সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। ইসলামের ইতিহাস থেকে এটাই প্রমানিত।

আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন উত্তম চরিত্র ও মাধুর্যপূর্ণ আচরণের অধিকারী। এ বিষয়ে স্বয়ং আল্লাহতায়ালাই প্রশংসা করে বলেন, ‘আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’ (সুরা আল কালাম: আয়াত-৪)। সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় আমি মহৎ চারিত্রিক গুণাবলির পূর্ণতা দান করার উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়েছি।’ (বায়হাকি)। নবুওয়তের ধারাবাহিকতার শেষপ্রান্ত তিনি হচ্ছেন নবী পরম্পরা পরিসমাপ্তকারী- শেষ নবী। তারপর আর কোনো নবী আসবে না। কোরআন মাজিদে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নন, বরং সে আল্লাহর রাসুল এবং শেষ নবী। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।’ (সুরা আল আহজাব: আয়াত- ৪০)। যুগে যুগে যেসব নবী ও রাসুল আগমন করেছেন তাদের ওপর নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘ছয়টি দিক থেকে সব নবীর ওপর আমাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে। আমাকে জাওয়ামিউল কালিম তথা ব্যাপক অর্থবোধক সংক্ষিপ্ত বাক্য বলার যোগ্যতা দেওয়া হয়েছে, আমাকে ভীতি (শত্রুর অন্তরে আমার ব্যাপারে ভয়ের সঞ্চার করা) দ্বারা সাহায্য করা হয়েছে, গনিমতের মাল (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) আমার জন্য বৈধ করা হয়েছে, আমার জন্য সব ভূমিকে পবিত্র ও সিজদার উপযুক্ত করা হয়েছে, আমি সব মানুষের তরে প্রেরিত হয়েছি এবং আমার মাধ্যমে নবুওয়ত পরম্পরা শেষ করা হয়েছে।’ (সহিহ মুসলিম: হাদিস-১১৯৫)। যে ব্যক্তির মধ্যে রাসুলের ভালোবাসা থাকবে না, সে কোনোদিন মুমিন হতে পারবে না। এমনকি নিজের জীবন থেকেও তার প্রতি বেশি ভালোবাসা থাকতে হবে। কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘নবী মুমিনদের কাছে তাদের নিজেদের অপেক্ষা ঘনিষ্ঠতর।’ (সুরা আল আহজাব: আয়াত- ৬)। কেয়ামতের কঠিন মুসিবতের দিনে আল্লাহতায়ালার অনুমতিক্রমে তিনি গোনাহগার উম্মতের জন্য শাফায়াত (সুপারিশ) করবেন। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণিত হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কেয়ামতের দিন আমি সব আদম সন্তানের নেতা। এতে কোনো গর্ব-অহঙ্কার নেই। সেদিন আমার হাতে প্রশংসার ঝাণ্ডা থাকবে তাতে কোনো গর্ব-অহঙ্কার নেই। আদম থেকে নিয়ে যত নবী-রাসুল আছেন সবাই আমার ঝাণ্ডার নিচে থাকবেন। আমি হচ্ছি প্রথম সুপারিশকারী এবং আমার সুপারিশই সর্বপ্রথম কবুল করা হবে। এতে কোনো গর্ব-অহঙ্কার নেই।’ (ইবনে মাজাহ)।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দীনে অটল থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: অধ্যক্ষ এম সোলাইমান কাসেমী, পিএইচ.ডি গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।

after post box 2