সর্বশেষ

শব্দ দূষণে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে

123
Before post box 1

 

নিউজ ডেস্ক : সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দে জনস্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। আর এ শব্দ দূষণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। নীরব ঘাতক শব্দ দূষণের ফলে শিশু, বয়স্ক, গর্ভবতী এবং অসুস্থ ব্যক্তিসহ সব বয়সী মানুষের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। শব্দ দূষণের অন্যতম উৎসগুলো হচ্ছে, বিভিন্ন যানবাহনে ব্যবহৃত হাইড্রোলিক হর্ন, নির্মাণ কাজে বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ব্যবহার, রাজনৈতিক, সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উচ্চ শব্দে মাইক বা সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার, পটকা ফাটানোর উচ্চ শব্দ।শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয়, পুরো দেশেই শব্দ দূষণ মাত্রাতিরিক্ত হারে বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) ১৯৯৯ সালের নির্দেশনা অনুযায়ী, মানুষের জন্য শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫৫ ডেসিবল। বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবল। সংস্থাটির পক্ষ থেকে ২০১৮ সালের নির্দেশিকায় সড়কে শব্দের তীব্রতা ৫৩ ডেসিবলের মধ্যে সীমিত রাখার সুপারিশ করা হয়। বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালাতেও একই মাত্রাকে সহনীয় মাত্রা হিসেবে ধরা হয়েছে। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক গবেষণার দেখা যায়, ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রার থেকে প্রায় ১.৩ থেকে ২ গুণ বেশি। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনেই শব্দের তীব্রতা সহনীয় মাত্রার বেশি।

সার্বিকভাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে ৭৬.৮০ ডেসিবল। নিউমার্কেট, নয়াপল্টন এবং প্রেসক্লাব মোড়ে দূষণের মাত্রা যথাক্রমে ১০০.৬৫, ৯২.২২, ৯০.০৩ ডেসিবল। অপেক্ষাকৃত কম শব্দ পাওয়া গিয়েছে আবুল হোটেল, দৈনিক বাংলা এবং জিরো পয়েন্ট মোড়ে। এসব এলাকায় শব্দ দূষণের মাত্রা যথাক্রমে ৭৮.২৭, ৭৭.৯২, ৭৭.৬০ ডেসিবল।

সার্বিকভাবে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে ৮০.৫৬ ডেসিবল। মোহাম্মদ বাসস্ট্যান্ড, শিয়া মসজিদ এবং মাসকট প্লাজা মোড়ে শব্দ দূষণের মাত্রা যথাক্রমে ৯৯.৭৭, ৯৩.০৫, ৯০.২৭ ডেসিবল। অপেক্ষাকৃত কম শব্দ পাওয়া গিয়েছে মিরপুর বেড়ীবাঁধ, রবীন্দ্রস্বরণী এবং গুলশান-২ মোড়ে। এসব এলাকায় শব্দ দূষণের মাত্রা যথাক্রমে ৭৪.৮৬, ৭৫.২৫ এবং ৭৬.০১ ডেসিবল।

চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, শব্দের মাত্রা ৮৫ ডেসিবলের বেশি হলে, সেটা মানসিক এবং শারীরিকভাবে অত্যন্ত ক্ষতিকর, যা শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষের নানাবিধ স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে।

শব্দ দূষণ প্রসঙ্গে হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, শব্দ দূষণের কারণে প্রথমত মানুষের কান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, শোনার ক্ষমতা কমে যায় এবং ক্রমান্বয়ে বধিরতা তৈরি হয়। কানের ভেতরে ঝিঝি শব্দ, মাথা ব্যথা, অস্বস্তি এবং মেজাজ খিটখিটে ভাব হয়। শব্দ দূষণের ফলে হৃৎপিন্ডের নাভীর গতি ও ব্লাড প্রেশার বেড়ে যায় এবং হৃদপিন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

middle of post box 3

এছাড়াও ক্রমান্বয়ে শব্দ দূষণের মধ্যে থাকলে মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা কমে যায় এবং স্মৃতিভ্রংশতা তৈরি হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, শব্দ দূষণের ফলে মানুষ অন্যান্যদের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, ফলে ব্যক্তিত্বের অবনমন ঘটে ভারসাম্যহীন ব্যক্তিত্বের তৈরি হয়। শব্দ দূষণের ফলে শিশুদের পড়াশোনায় মনোযোগ কমে যায়। সুতরাং শব্দ দূষণ একদিকে যেমন বিভিন্ন রোগ তৈরি করে, তেমনিভাবে জীবনমান কমিয়ে দেয়।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) নাক কান গলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. হাসানুল হক নিপুন বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের হেডারিং লেভেল ধার্য করেছে ৫৫ ডেসিবল। একটি স্টাডি থেকে আমরা দেখেছি ঢাকা শহরে ১১৫ থেকে ১৩০ ডেসিবল শব্দ তৈরি হয়। অর্থাৎ স্বাভাবিক শব্দের চেয়ে দ্বিগুণ শব্দ দূষণ তৈরি হয়। শব্দ দূষণের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ট্রাফিক পুলিশ। এছাড়াও নারী শিশু এবং সব বয়সের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৫ থেকে ৭ বছর কেউ এমন শব্দ দূষণের ভেতরে থাকলে তার স্বাভাবিক শ্রবণ শক্তি কমে যাবে, তার ঘুমের সমস্যা হবে। ঘুমের সমস্যার ফলে রক্তচাপ বেড়ে যাবে, শারীরিক দুর্বলতা দেখা যাবে, কাজে মনোযোগ কমে যাবে। ঘুমের প্যাটার্ন নষ্ট হয়ে গেলে তার শরীরে সব জায়গায় প্রভাব পড়বে, সবচেয়ে বেশি সে মানসিক অবসাদগ্রস্ত হবে।

গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি প্রসঙ্গে বিএসএমএমইউয়ের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. রেজাউল করিম কাজল বলেন, শব্দ দুষণের ফলে গর্ভবতী মায়েদের বেশি ক্ষতি হয়। কানের সমস্যা হতে পারে, উচ্চ রক্তচাপ, বুক ধরফর, হার্টবিট বেড়ে যেতে পারে। মা যখন উচ্চ রক্তচাপ, মানসিক অস্থিরতায় ভোগে, ঘুম ঠিকমত না হলে, এর প্রভাব বাচ্চার ওপরে পড়ে। শেষের তিন মাস বাচ্চারা বাইরের শব্দ শুনতে পায়। উচ্চ শব্দে তাদেরও হার্টবিট বেড়ে যায়, এতে বাচ্চাদের স্নায়বিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে, ওজন কমে যেতে পারে, এমনকি সময়ের আগেই প্রিম্যাচ্যুর বাচ্চার জন্ম হতে পারে। এজন্য আমরা বলি গর্ভবতী মায়েরা যেন ৮৫ ডেসিবলের অধিক শব্দের স্থানে না যায়।

শব্দ দূষণ প্রতিরোধে ক্যাপসের গবেষণা দলের প্রধান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, শব্দ দূষণ রোধকল্পে ঢাকা শহরকে হর্ন মুক্ত নগরী হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। নিষিদ্ধ ঘোষিত হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যাত্রী, চালক এবং গাড়ি মালিকদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী, চিহ্নিত এলাকাগুলোতে (নীরব, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প ও মিশ্র) সাইনবোর্ড লাগাতে হবে।

শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) ব্যবহার করে শব্দ দূষণকারী গাড়ির নাম্বার প্লেটসহ ছবি তুলে ফেলা যায়। এছাড়াও বড় আমলা, প্রভাবশালী এবং ধনিক শ্রেণীর ক্ষমতাধর ব্যক্তি হলেই হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারের অধিকার থাকবে, সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, পাশাপাশি অযথা যারা হর্ন বাজায় তাৎক্ষণিকভাবে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ার যথাযথ ক্ষমতা যদি পুলিশকে দেওয়া হয়, তাহলে শব্দ দূষণ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া খুব সহজ। এর সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে সিটি কর্পোরেশনকে যুক্ত করে নির্মাণ কর্মকাণ্ডে শব্দ দূষণ জনিত জরিমানা আদায় করার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এই পদক্ষেপ এককভাবে শব্দ দূষণের দায়ী উৎসগুলোকে কমাতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ যোগ্য। আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন করতে পারলে শব্দ দূষণ অনেকটাই কমে যাবে। পাশাপাশি শব্দ দূষণের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকিও কমবে।

after post box 2