সর্বশেষ

মা ছেলের জন্য ত্যাগ স্বীকারের অনন্য দৃষ্টান্ত

119
Before post box 1

 

নিউজ ডেস্ক :: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩তম সমাবর্তনে ছেলে শাকিল আনোয়ারের সঙ্গে মা শামসুন নাহার । স্বামী গোলাম রহমান যখন মারা যান, তখন শামসুন নাহারের বয়স ত্রিশের কোঠায়। ছেলে শাকিল আনোয়ারের বয়স মাত্র সাড়ে পাঁচ বছর, আর মেয়ের বয়স ছিল নয় বছর। গোলাম রহমান সঞ্চয়ী ছিলেন না। তাই শামসুন নাহারকে দুই ছেলে–মেয়ে নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের স্কুলে শিক্ষকতা করে ১ হাজার ৫০০ টাকা বেতনে দুই ছেলে-মেয়েকে বড় করেছেন। এই তিনজনের খাবারে পুরো মাসেও মাছ-মাংসের দেখা পাওয়া যেত না। হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে ১৯ বছর ধরে শামসুন নাহার সংগ্রাম করে চলছেন। এইচএসসি পর্যন্ত পড়িয়ে মেয়েকে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। শাকিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতক পাস (সিজিপিএ-৩.৭৬) করেছেন। স্নাতকোত্তরে পড়ছেন এখন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩তম সমাবর্তনে ছেলের পাশে থাকার জন্য পঞ্চগড় থেকে ঢাকায় এসেছিলেন শামসুন নাহার। সমাবর্তনে শাকিলের বন্ধুর কালো গাউন ও টুপি পরে ছেলের সঙ্গে ছবি তুলেছেন। তখন তিনি সুখের কান্না আটকে রাখতে পারেননি।

শাকিল পঞ্চম শ্রেণি থেকে বিভিন্ন ক্লাসে ভালো ফলের জন্য বৃত্তি পেয়েছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই টিউশনি করেছেন। তাঁর মা স্কুলের চাকরি শেষ করে বিকেলে বাড়িতে বাচ্চাদের পড়াতেন। শাকিল আনোয়ার বলেন, ‘আম্মু চাইলেই আবার বিয়ে করে নিজের জীবন গড়তে পারতেন। তখন নাকি আম্মুর জন্য বিয়ের অনেক প্রস্তাবও এসেছিল। কিন্তু আম্মু শুধু আমাদের দুই ভাই-বোনের কথা চিন্তা করে বিয়ে করেননি। এখনো সংগ্রাম করেই যাচ্ছেন। আমাদের খাবারের ঘাটতি থাকত সব সময়। বাজারে গিয়ে সবচেয়ে কম দামি শাকসবজি কিনতাম। মাছ বা মাংস কিনতে পারতাম না। শাকসবজির পরিমাণও থাকত কম। আম্মু নিজে না খেয়ে আমাদের খাওয়াতেন। এখন বিভিন্ন রোগ বাসা বেঁধেছে মায়ের শরীরে। আম্মু না থাকলে আজ আমি এত দূর আসতে পারতাম না।’

পঞ্চগড় থেকে মুঠোফোনে শামসুন নাহার বলেন, ‘বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু দুই ছেলে-মেয়েকে কে দেখবে? ১৯ বছর ধরেই সংগ্রাম করছি। ১২ বছর ব্র্যাকের স্কুলে চাকরি করেছি। এরপর একটি এনজিওতে চাকরি করেছি। এখন আমার আর কোনো দুঃখ নেই। আমার ছেলে-মেয়েরা মানুষ হয়েছে, ভালো আছে। ছেলে এখন আর আমাকে চাকরি করতে দেয় না।’মায়ের পাশাপাশি বাবার সহকর্মীদের পাশে পেয়েছেন শাকিল। শাকিল আনোয়ারের বাবা ও মা দুজনই ছিলেন স্নাতকোত্তর। বাবা গোলাম রহমান ছিলেন পঞ্চগড়ের মানিকপীর বেংহারী ফাজিল মাদ্রাসার আরবি প্রভাষক। আর মা প্রথমে বেসরকারি সংস্থা আরডিআরএসে চাকরি করতেন। পরে মানিকপীর গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গোলাম রহমান। স্কুলটি প্রতিষ্ঠার জন্য জমি বিক্রিসহ বিভিন্ন সময় প্রচুর টাকা খরচ করেন। তখন তাঁর আর্থিক অবস্থা বেশ সচ্ছলই ছিল। তবে নিজের পরিবারের জন্য কোনো সঞ্চয় করেননি। মানিকপীর গার্লস হাইস্কুলের বেতন–ভাতা নিয়ে সমস্যা চলছিল। তাই শামসুন নাহার চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলেন। আর তারপর হুট করেই মারা যান গোলাম রহমান। তখন ব্র্যাকের স্কুলের চাকরি করা ছাড়া তাঁর আর কোনো গতি ছিল না।

শাকিল আনোয়ার জানান, তাঁর দাদার আমলে বানানো একটি কাঠের ঘরই ছিল তাঁদের সম্বল। দাদা, দাদি, নানা, নানি বেঁচে নেই। মায়ের ব্র্যাক স্কুলের বেতন আর বড় চাচাসহ বিভিন্নজনের সহায়তায় শাকিলের পড়াশোনা চলতে থাকে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মায়ের ব্র্যাক স্কুলে বিনা মূল্যে পড়েন শাকিল। এরপর ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে আলিম (এইচএসসি) পর্যন্ত বাবা যে মাদ্রাসায় চাকরি করতেন, সেখানে পড়ার সুযোগ পান।

কথা বলার সময় শাকিল এ পর্যন্ত যাঁরা তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন, সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। মাদ্রাসায় পড়ার সময় তাঁর বাবার সহকর্মীরা খাতা-কলম কিনে দিতেন, সৌজন্য কপি হিসেবে পাওয়া বইগুলো পড়তে দিতেন। টিফিনের জন্য টাকা দিতেন। শাকিল বলেন, ‘সেই সময় টিফিনের জন্য পাঁচ টাকা পাওয়াও আমার জন্য অনেক কিছু ছিল। পরীক্ষার ফিসহ অনেক কিছুতে আমার জন্য ছাড় ছিল। স্যাররা ছিলেন বলেই আমাদের মা ও ছেলের সংগ্রাম কিছুটা কম করতে হয়েছে।’

শাকিল আনোয়ার বলেন, ‘আমি এখন খুব ভালো আছি। মাকে একটি বাড়ি করে দিয়েছি। মা একা বাড়িতে থাকেন, ঢাকায় নিজের কাছে এনে রাখতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সাধ্যে কুলাচ্ছে না। আপাতত অপূর্ণতা বলতে এটুকুই।’
মাদ্রাসায় পড়ুয়া শাকিলের পাশে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন সংগঠন
শাকিল পঞ্চম শ্রেণি থেকে বিভিন্ন ক্লাসে ভালো ফলের জন্য বৃত্তি পেয়েছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই ছাত্র পড়িয়েছেন। তাঁর মা স্কুলের চাকরি শেষ করে বিকেলে বাড়িতে বাচ্চাদের পড়াতেন।

middle of post box 3

শাকিল জানান, আলিম (এইচএসসি) পড়ার সময় আর্থিক অনটন আরও প্রকট হয়। বোনের পড়াশোনা, বাড়িতে তিনজনের খাবারসহ অন্যান্য খরচ তো ছিলই। এ সময় প্রথম আলোর তখনকার পঞ্চগড় প্রতিনিধি শহিদুল ইসলামের মাধ্যমে ‘ঘুড্ডি ফাউন্ডেশন’-এর খবর পান শাকিল। ঢাকায় এসে পরীক্ষা দিয়ে ফাউন্ডেশন থেকে দুই বছরের জন্য মাসিক দেড় হাজার টাকা বৃত্তি পান। এইচএসসি পাসের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোচিং, ভর্তি হওয়া নিয়ে আবার অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। রংপুরে কোচিংয়ের জন্য থাকা-খাওয়াসহ সব খরচ দেন শাকিলের বড় চাচা মানিকপীর উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. আফসার আলী, বাবার বন্ধু ও সহকর্মীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় খ ইউনিটে ১২২তম হন শাকিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আত্মীয়স্বজন ও মাদ্রাসার শিক্ষকেরা শাকিলকে কিছু টাকার ব্যবস্থা করে দেন। শাকিলকে টাকা ধারও করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ঘুড্ডি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ‘মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এ আবার বৃত্তির জন্য আবেদন করেন। তখন ফাউন্ডেশন ভর্তির পুরো টাকা দেয়। এ টাকা দিয়েই শাকিল তাঁর ধার শোধ করেন। তার পর থেকে শাকিলকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন থেকে মাসিক চার হাজার টাকা করে বৃত্তি পান। পড়াশোনার পাশাপাশি শাকিল ফাউন্ডেশনে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ শুরু করেন। এখন এ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকদের কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

ঘুড্ডি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমেই শাকিল বর্ণ অ্যাডমিশন কেয়ার নামের কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেওয়ার সুযোগ পান। আর এ কোচিং সেন্টারের শিক্ষার্থীদের জন্য রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বছিলায় হোস্টেল চালু করার সুযোগ পান শাকিল। হোস্টেল থেকে বছরে চার থেকে পাঁচ মাস আয় করছেন। টিউশনি এবং হোস্টেলের আয় দিয়েই বছরের অন্য সময় চলে যাচ্ছে শাকিলের। হোস্টেলে বাবুর্চিসহ বিভিন্ন পদে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও হচ্ছে। আর নিজে আয় করা শুরুর পর থেকে মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন থেকে যে মাসিক বৃত্তি পেতেন, তা নেওয়া বন্ধ করে দেন।

শাকিলের বড় চাচা মানিকপীর উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. আফসার আলী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘শাকিল শুধু আমাদের বংশে নয়, আমাদের গ্রামেও প্রথম ব্যক্তি, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট হলো। আমরা তাকে নিয়ে গর্ব করি। শাকিলের বাবা সমাজসেবক ছিলেন। স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ওয়ারিশ সূত্রে পাওয়া জমিও বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তারপর হুট করে মারা গেলে শাকিলের মাকে সংসার চালাতে অনেক কষ্ট করতে হয়। আমিসহ অন্যরা যতটুকু সামর্থ্য, সে অনুযায়ী সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। তবে শাকিল কষ্ট করেই আজ এ পর্যন্ত এসেছে।’

যুক্তরাষ্ট্রে থাকা মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি চন্দ্র নাথ ফেসবুকে শাকিল আনোয়ারকে নিয়ে লিখেছেন বিভিন্ন সময়। তিনি তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন, মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা করে আসা শাকিলই তাঁদের ফাউন্ডেশনের প্রথম শিক্ষার্থী। প্রথম দিকে শাকিলকে নিয়ে দ্বিধা থাকলেও তিনি এখন ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন কাজে মূল স্তম্ভ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। করোনার সময় ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ২৮ লাখ টাকার ত্রাণসামগ্রী বিতরণেও শাকিল তাঁর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন।

গত বছর পারিবারিকভাবেই শাকিল বিয়ে করেছেন। তাঁর স্ত্রী আসমা খাতুন পড়ছেন রাজধানীর গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে। বর্তমানে শাকিল মা, স্ত্রী এবং নিজের খরচ বহন করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পাশাপাশি বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

সব মিলে কেমন আছেন জানতে চাইলে শাকিল হেসে বললেন, ‘আমি এখন খুব ভালো আছি। মাকে একটি বাড়ি করে দিয়েছি। মা একা বাড়িতে থাকেন, ঢাকায় নিজের কাছে এনে রাখতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সাধ্যে কুলাচ্ছে না। আপাতত অপূর্ণতা বলতে এটুকুই। মা আমাদের জন্য সারা জীবন কষ্ট করেছেন, এখন একটু আরামে রাখতে পারলে নিজেও শান্তি পেতাম।’

after post box 2