সর্বশেষ

চট্টগ্রামের বিখ্যাত ঐতিহ্য -অধ্যক্ষ এম সোলাইমান কাসেমী

239
Before post box 1

নিউজটিভিবিডি ডেস্ক, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, শনিবার :: বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ইতিহাস বেশ পুরনো। প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্যের মধ্যে এই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি মসজিদ উল্লেখযোগ্য।

আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ : ইতিহাস আর ঐতিহ্যের এক অন্যতম স্থাপত্য আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ। প্রায় সাড়ে তিনশ বছর আগে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম সদরে নির্মিত এই এ মসজিদটি ঘিরে রয়েছে অসংখ্য ইতিহাস ও মোগল সাম্রাজ্যের অনন্য নিদর্শন।জানা যায়, ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রামের তৎকালীন মোগল শাসনকর্তা সুবেদার নবাব শায়েস্তা খাঁর পুত্র উমেদ খাঁ মগ ও পর্তুগিজদের একটি আস্তানার অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে এর নামকরণ করা হয় ‘আন্দরকিল্লা’। যুদ্ধ বিজয়ের স্মারক হিসেবে দিল্লির সম্রাট আওরঙ্গজেব চট্টগ্রামের নতুন নামকরণ করেন ইসলামাবাদ। তারই নির্দেশে চট্টগ্রাম বিজয়ের মোগল স্মারক চিহ্ন হিসেবে শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৭ সালে ‘আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ’ নির্মাণ করেন। দিল্লি’র এক ঐতিহাসিক জামে মসজিদের অবয়বে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ত্রিশ ফুট ওপরে ছোট্ট পাহাড়ের ওপর মসজিদটির অবস্থান। মূল মসজিদের নকশা অনুযায়ী, আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদ ১৮ গজ (১৬ মিটার) দীর্ঘ, ৭ দশমিক ৫ গজ প্রস্থ। প্রতিটি দেয়াল প্রায় ২ দশমিক ৫ গজ পুরু। পশ্চিমের দেয়াল পোড়া মাটি এবং বাকি তিনটি দেয়াল পাথর দিয়ে তৈরি। মধ্যস্থলে একটি বড় এবং দুটি ছোট গম্বুজ দ্বারা ছাদ আবৃত। ১৬৬৬ সালে নির্মিত মসজিদের চারটি অষ্টভুজাকৃতির গম্বুজগুলোর মধ্যে পেছন দিকের দুটি এখনো বিদ্যমান রয়েছে। মসজিদটির পূর্বে তিনটি, উত্তর এবং দক্ষিণে একটি করে মোট ৫টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। মসজিদটিতে তিনটি মেহরাব থাকলেও সাধারণত মাঝের সর্ববৃহৎ মেহরাবটিই বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে। আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ নির্মাণের প্রায় ৫৬ বছর পর অর্থাৎ ১৭২৩ খ্রিস্টাব্দে আরেক শাসনকর্তা নবাব ইয়াসিন খাঁ মসজিদের সন্নিকটের পাদদেশের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের একটি টিলার ওপর আরেকটি পাকা মসজিদ নির্মাণ করেন। যার নামকরণ করা হয় ‘কদম রসুল’। এক সময় আন্দরকিল্লা মসজিদের চেয়ে কদম রসুল মসজিদটি বেশ জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। যার কারণে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ মুসল্লিদের গ্রহণযোগ্যতা হারায়। এক পর্যায়ে মসজিদটি লোকশূন্য হয়ে পড়লে এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদটিকে তাদের গোলাবারুদ রাখার গুদাম হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। ১৮৮৫ সালে নবাব হামিদুল্লাহ খাঁর বিশেষ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মসজিদটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য পুনরায় উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এরপর ১৬৬৭ সাল থেকে এ মসজিদ ঘিরে চট্টগ্রামের ইসলামি ধর্মাবলম্বীদের ব্যাপক আনাগোনা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই মহানবীর বংশধররা (আওলাদে রাসুলরা) এ মসজিদের খতিব হিসেবে নিযুক্ত হতেন। যার ধারাবাহিকতা এখনো রয়েছে। বর্তমানে এ মসজিদটির খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আওলাদে রাসুল সাইয়্যেদ আনোয়ার হোসাইন তাহের জাবেরি আল মাদানি এবং নিয়মিত ইমামতি করছেন ৩ জন ইমাম, ২ জন মুয়াজ্জিন ও ৭ জন খাদেম। মসজিদটির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মসজিদে প্রতিদিন অন্তত ৪ হাজার মুসল্লি নিয়মিত নামাজ আদায় করতে পারার ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। মসজিদে প্রতি শুক্রবার একত্রে গড়ে ৮ থেকে ৯ হাজার মানুষ নামাজ আদায় করেন। পবিত্র রমজান মাসের জুমআতুল বিদায় ২০ থেকে ২৩ হাজার মানুষের বিশাল জামাত অনুষ্ঠিত হওয়ার নজিরও রয়েছে। প্রতি বছর পবিত্র মাহে রমজানের প্রথম রোজা থেকে শেষ রোজা পর্যন্ত এই মসজিদে নগরের বিত্তবান শিল্পপতিদের অনুদানে ২ থেকে ৩ হাজার মানুষের জন্য বিশাল ইফতারের আয়োজন করা হয়। ইফতার আয়োজনে অংশ নিতে বিভিন্ন গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ছুটে আসেন শত শত মানুষ। রমজানে মসজিদের আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, মুসলমান রোজাদার ব্যক্তিরা ছাড়াও হিন্দু ধর্মাবলম্বীর মানুষরাও ইফতারে শরিক হন। তাদের মতে, এই মসজিদে ইফতার গ্রহণ করলে সুফল লাভ করা যায়। প্রায় ১ দশক আগে শুরু হওয়া মসজিদের বিশাল এ ইফতার আয়োজনে আর্থিকভাবে যারা সহযোগিতা করেন তাদের বেশিরভাগই চট্টগ্রামের শিল্পপতি। তবে তাদের অনুরোধেই এত বড় আয়োজনে তাদের নাম প্রকাশ করা হয় না।

চন্দনপুরা হামিদিয়া তাজ মসজিদ : বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম নিদর্শন বন্দরনগরী চট্টগ্রামের চন্দনপুরা হামিদিয়া তাজ মসজিদ। চোখ ধাঁধানো কারুকাজে নির্মিত সুসজ্জিত এ মসজিদটি আকর্ষণ কেড়ে নেয় সবার। ইতিহাস মতে, ১৬৬৬ সালে নবাব শায়েস্তা খানের সেনাদল আরাকান মগ রাজাদের কবল থেকে চট্টগ্রামকে স্বাধীন করার পর সেখানে মোগল শাসন কায়েম করেন। তখন থেকেই শাহী ফরমানের অঞ্চলে অনেকগুলো মসজিদ নির্মাণ করা হয় এই নগরে। এছাড়াও ইসলামি নগরখ্যাত চট্টগ্রামে মোগল সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে রয়েছে একাধিক মসজিদ। এর মধ্যে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ, অলি খাঁ জামে মসজিদ অন্যতম। ইতিহাসনন্দিত সেই মসজিদগুলো আজও স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার ওয়ার্ডে অবস্থিত দৃষ্টিনন্দন চন্দনপুরা হামিদিয়া তাজ মসজিদ ঘিরে রয়েছে অসংখ্য মানুষের আনাগোনা। শুধু নগরবাসীই এই মসজিদে আসেন এমন নয়, এই মসজিদটি এক নজর দেখতে ছুটে আসেন দেশি-বিদেশি পর্যটকরাও। চন্দনপুরা মসজিদে আছে ১৫টি গম্বুজ। এর মধ্যে বড় গম্বুজটির নির্মাণ সামগ্রী আনা হয়েছিল ভারতবর্ষ থেকে। সেই সময়ের প্রায় ৪ লাখ টাকার ১৫ মণ রুপা ও পিতল ব্যবহার করা হয় গম্বুজটি নির্মাণে। গম্বুজের চারপাশে লেখা রয়েছে শিলালিপিতে আহলে বায়তে রাসুলসহ দুনিয়ায় জান্নাতের সুসংবাদ পাওয়া ১০ সাহাবির নাম। মসজিদটির সুউচ্চ মিনার থেকে শুরু করে দেয়াল, উঁচু পিলার, দরজা ও জানালা সব কিছুতেই দারুণ কারুকাজ দৃশ্যমান। ইতিহাসে উল্লেখ আছে, ১৬৬৬ সালে মসজিদটির ভিত্তিপ্রস্তর করা হয়। ১৯৫০ সালে এর পূর্ণ সংস্করণের কাজ সম্পন্ন করা হয়। প্রথম পর্যায়ে মাস্টার আবদুল হামিদ নামে এক ধনাঢ্য ব্যক্তি মসজিদটির সংস্কারের উদ্যোগ নেন। পরে তার মৃত্যুর পর মাস্টার আব্দুল হামিদের জ্যেষ্ঠ পুত্র আবু সাইয়্যিদ দোভাষ ১৯৪৬ সালে এটির সংস্কার ও পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু করেন। মসজিদটির পরিচিতি বৃদ্ধি পেতে সহায়তা করেছে ‘এশিয়া ট্রাভেল ট্যুরস’ নামের একটি জনপ্রিয় ম্যাগাজিন। তারা তাদের প্রচ্ছদে এই মসজিদের ছবি ব্যবহার করলে বিশ্ববাসী ঐতিহাসিক এই মসজিদ সম্পর্কে জানতে পারে। চট্টগ্রামের আইকনিক চিত্র কিংবা ডকুমেন্টোরিগুলোতে এই মসজিদটির স্থান শীর্ষে। ষাটোর্ধ্ব এক মুসল্লি জানান, প্রথমদিকে বহু বছর মসজিদটিতে মাইকের ব্যবহার না থাকায় মোয়াজ্জিনরা ৪ তলা সমান উঁচু মিনারে উঠে উচ্চৈঃস্বরে আজান দিতেন। দোতলা মসজিদটিতে একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন অন্তত ৩ হাজার মুসল্লি। মসজিদে নিয়মিত ইমামতি করছেন ২ জন ইমাম, ১ জন খতিব ও ৩ জন মুয়াজ্জিন। এছাড়াও ঐতিহাসিক সংরক্ষিত বিভিন্ন দুর্লভ জিনিসের পাহারায় নিয়োজিত থাকেন পর্যাপ্ত পরিমাণ নৈশপ্রহরী।

সাহেব বিবি মসজিদ : চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার ৯ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত প্রায় ৮০০ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সাহেব বিবি মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল মোগল আমলে। ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, জমিদার আমির মোহাম্মদ চৌধুরীর পতœী ও চট্টগ্রামের আলোচিত সুপ্রসিদ্ধ মালকা বানুর মাতা সাহেব বিবি এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা যার কারণে তার নামেই এই মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছিল।
৩০ শতক জমির ওপর চুন সুরকির গাঁথুনিতে নির্মাণ করা হয়েছিল দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপনাটি। ঐতিহ্যবাহী সাহেব বিবি জামে মসজিদটি দাঁড়িয়ে আছে ৮টি পিলার, ৩টি দরজা, ২টি জানালা ও সুউচ্চ ১টি গম্বুজের ওপর। মসজিদের পশ্চিম পাশেই রয়েছে সুদীর্ঘ ১টি মিনার। প্রশস্ত জায়গার ওপর নির্মিত মসজিদের সামনে রয়েছে পবিত্র কাবা শরিফের আদলে তৈরি করা আকর্ষণীয় একটি প্রবেশদ্বার। মসজিদের পাশেই রয়েছে ফুলের বাগান সংবলিত কবরস্থান। সেই কবরস্থানেই ঐতিহ্যবাহী সাহেব বিবি জামে মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা মরহুমা সাহেব বিবি’কে সমাধিস্থ করা হয়। এর সামনে নির্মাণ করা হয়েছে ঈদগাহ। ডান পাশে রয়েছে বিশালাকার এক শাহী পুকুর। এটি ‘সাহেব বিবির দিঘি’ হিসেবে এলাকাবাসীর কাছে পরিচিত। তৎকালে ঐতিহাসিক সাহেব বিবি মসজিদসহ বাদশা মুহাম্মদ শাহ এস্টেটের আমলে ডিমের আটা, চুন-সুরকি দিয়ে দেশের ২২টি গ্রামে একই রকম আরও মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই ২২টি মসজিদের মধ্যে সর্বপ্রথম সাহেব বিবি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। ঐতিহাসিক সাহেব বিবি মসজিদ চট্টগ্রাম বিভাগের সবচেয়ে সুপ্রাচীন মসজিদ হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে। যার কারণে নান্দনিক এই স্থাপনাটি এক নজর দেখতে ছুটে আসেন দূর-দূরান্তের বহু মানুষ। মসজিদটিতে প্রায় শতাধিক মুসল্লি একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন। লোকমুখে শোনা যায়, আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে তৎকালীন বাদশাহ ৮ মাইল হেঁটে এ মসজিদে এসে নামাজ আদায় করতেন।

বজরা শাহী মসজিদ : মোগল সম্রাট মুহাম্মদ শাহের আমলে দিল্লির বিখ্যাত জামে মসজিদের অনুকরণে জমিদার আমান উল্যাহ ১১৫৪ হিজরি সাল, ১১৩৯ বাংলা মোতাবেক ১৭৪১ সালে অর্থাৎ প্রায় পৌনে তিনশ বছর আগে চট্টগ্রাম বিভাগের সোনাইমুড়ী উপজেলার বজরা নামক এলাকায় বজরা শাহী মসজিদ নির্মাণ করেন। জমিদার আমান উল্যাহ নিজের বাড়ির সামনে প্রায় ৩০ একর জমির ওপর উঁচু পাড়যুক্ত একটি বিশাল একটি দিঘি খনন করেন। সেই দিঘির পশ্চিম পাড়ে মনোরম পরিবেশে আকর্ষণীয় তোরণ বিশিষ্ট ১১৬ ফুট দৈর্ঘ্য, ৭৪ ফুট প্রস্থ এবং প্রায় ২০ ফুট উঁচু ৩টি গম্বুজ বিশিষ্ট ঐতিহাসিক বজরা শাহী মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদকে মজবুত করার জন্য মাটি থেকে প্রায় ২০ ফুট গভীরে পিলার গাঁথা হয়। মসজিদে প্রবেশের জন্য রয়েছে ৩টি ধনুক আকৃতির দরজা। ৩টি কারুকার্য খচিত মিহরাব রয়েছে।
ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, মোগল আমলের তৎকালীন সম্রাট মোহাম্মদ শাহের অনুরোধে পবিত্র মক্কা শরিফের নাগরিক অন্যতম বুজুর্গ আলেম হযরত মাওলানা শাহ আবু সিদ্দিকী বজরা শাহী মসজিদের প্রথম ইমাম হিসেবে নিয়োজিত হন। তার বংশধররা যোগ্যতা অনুসারে আজও এ মসজিদের ইমামের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
বর্তমানে প্রথম ইমামের সপ্তম পুরুষ ইমাম মাওলানা হাসান সিদ্দিকী এ মসজিদের ইমামের দায়িত্ব পালন করছেন। স্থানীয় এলাকাবাসীর ধারণায় ঐতিহাসিক বজরা শাহী জামে মসজিদে মানত করলে তাতে শুভ ফল পাওয়া যায়। যার কারণে মনের আশা পূর্ণ করতে, বিপদ থেকে মুক্তিলাভ ও দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় অসংখ্য নারী ও পুরুষ এ মসজিদে সপ্তাহে প্রতি শুক্রবার শিরনি, জিলাপি, মিষ্টি মানত নিয়ে আসেন। মসজিদটিতে প্রায় শতাধিক মুসল্লি একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন। এছাড়াও বিগত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পুরুষদের পাশপাশি দূরদূরান্ত থেকে আগত নারী দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা করেছে মসজিদ কর্র্তৃপক্ষ।

বখশী হামিদ মসজিদ : চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে সাড়ে চারশ বছরের প্রাচীন স্থাপনা বখশী হামিদ মসজিদ ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে তৎকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মসজিদের রক্ষিত আরবি ভাষার শিলালিপিতে লেখা আছে- ‘বুনিয়াল মাসজিদুল মোকাররম ফি আহদি মুলক, ইসনাদুল মিল্লাতি ওয়াদ্দিন সুলতানুল মুয়াজ্জম সুলাইমান (কররানি) সাল্লামাহু আনিল আফাতি ওয়াল বালিয়্যাতি মুয়াররিখা তিসয়ু রমজান, খামসুন ওয়া সাবউন ওয়া তিসআতু মিয়াতি হিজরি আলাইহিস সাল্লাম।’ অর্থাৎ এই পবিত্র মসজিদ নির্মিত হয়েছে জাতি ও ধর্মের রক্ষক মহান বাদশা সুলাইমান কররানির যুগে। (আল্লাহ তাকে যাবতীয় বিপদাপদ থেকে নিরাপদ রাখুক)। নির্মাণকাল ৩০ রমজান ৯৭৫ হিজরি।
১৫৬৮ সালের ৯ মার্চে নির্মিত এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদের রক্ষিত শিলালিপির তথ্য মতে, এটি সুলাইমান কররানি কর্র্তৃক প্রতিষ্ঠা করার কথা থাকলেও জনমুখে বখশী হামিদের নির্মিত মসজিদ বলেই বেশ পরিচিত। যার কারণে স্থানীয়রা এটিকে বখশী হামিদ মসজিদ নামেই চেনেন।
মসজিদটির প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আবদুল হামিদ বখশী তৎকালে সেই এলাকাটির একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সে সময় তিনি নিজ এলাকার শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতির ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন। মোগল স্থাপত্যে চট্টগ্রামের সাহেব বিবি মসজিদের অনুকরণে চুন ও সুরকি দ্বারা তৈরি করা হয়। মসজিদটিতে বড় ও ছোট ছোট তীরাকৃতির কয়েকটি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের পূর্ব পাশে রয়েছে প্রাচীনকালের শান বাঁধানো একটি সুবিশাল পুকুর। পুকুরটিতে প্রতি বছরই মাছ চাষ করা হয় এবং সেই পুকুরটির পানি ব্যবহার করে মুসল্লিরা অজু করেন। মসজিদের পশ্চিমে কবরস্থান ও উত্তরে গড়ে উঠেছে সুবিশাল দারুল কোরআন মুহাম্মদিয়া শাহ আব্দুল হামিদ মাদ্রাসা ও এতিমখানা। সেখানে অন্তত প্রায় শতাধিক স্থানীয় শিশু বর্তমানে ইসলামি শিক্ষা গ্রহণ করছে।

চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। বন্দরনগরী নামে পরিচিত শহর, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম জেলায় অবস্থিত। বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত পাহাড়, সমুদ্রে এবং উপত্যকায় ঘেরা চট্টগ্রাম শহর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যে প্রাচ্যের রাণী হিসেবে বিখ্যাত।

চট্টগ্রাম বহু বিখ্যাত লোকের জন্মস্থান। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, অনুপম সেন, সূর্য সেনের মতো বহু বিখ্যাত লোকের জন্মস্থান চট্টগ্রাম। আজ পরিচিত হবো এমনই কিছু বিখ্যাত ব্যক্তিদের সাথে।

শাহ আমানত রহ : শাহ আমানত (রহ.) চট্টগ্রামের বিখ্যাত দরবেশ। হজরত শাহ আমানত অত্যন্ত অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। কোর্টে দায়িত্ব পালন এবং আরাধনায় নিয়োজিত থাকা ছিল তাঁর দৈনন্দিন বাঁধাধরা কাজ। তিনি যে আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী তা কেউ জানত না। তাঁর আধ্যাত্মিক সিদ্ধির কথা প্রকাশ পেলে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেকে আরাধনায় নিয়োজিত রাখেন এবং চট্টগ্রামের বিখ্যাত দরবেশদের একজন রূপে গণ্য হন। বিশেষত মামলা মোকদ্দমার ব্যাপারে লোকজন তাঁর অনুগ্রহ লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর মাজার জিয়ারত করে। চট্টগ্রামের লালদিঘির পূর্ব দিকে এক সমাধিসৌধে হজরত শাহ আমানত সমাহিত আছেন।

হযরত বদর আউলিয়া : হযরত বদর আউলিয়া, বদর পীর ও বদর উদ্দিন আলম ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত থাকলেও তিনটি নামেই আমাদের চট্টগ্রাম শহরের আবাদ করা সেই মহান মনীষী হযরত বদর আউলিয়া (রা.) এর নাম। তাঁর পবিত্র স্মৃতির চিহ্ন আমাদের চট্টগ্রামকে গৌরব উজ্জ্বল করে রেখেছে। চট্টগ্রামকে বদর পীরের চট্টগ্রাম বলা হয়। ইতিহাস গবেষণায় প্রমাণিত হযরত বদর আউলিয়া (রা.) জঙ্গল পাহাড় ডাকা এই চট্টগ্রামকে জিন, ভূত, পেরত তাদেরকে তাড়িয়ে মানুষ বসবাসের আবাসস্থল তৈরি করেন। মহান সাধক পীর হযরত বদর আউলিয়ার সেই চিহ্ন চট্টগ্রাম নগরীর প্রাণ কেন্দ্র চট্টগ্রাম চেরাগীপাহাড় এ বিদ্যমান। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এই স্মৃতির চিহ্নকে সংরক্ষণপূর্বক নান্দনিকভাবে দেখার জন্য আলোকসজ্জা ও সুর্ন্দয্য বর্ধন করেছেন।

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার : প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার যিনি প্রীতিলতা ওয়াদ্দের নামেও পরিচিত। তার জন্ম ১৯১১ সালের ৫ মে। ডাকনাম রাণী, ছদ্মনাম ফুলতারা, একজন বাঙালি ছিলেন, যিনি ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নারী মুক্তিযোদ্ধা ও প্রথম বিপ্লবী মহিলা শহিদ ব্যক্তিত্ব। তৎকালীন পূর্ববঙ্গে জন্ম নেয়া এই বাঙালি বিপ্লবী সূর্য সেনের নেতৃত্বে তখনকার ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং জীবন বিসর্জন করেন।

বিনোদ বিহারী চৌধুরী : বিনোদ বিহারী চৌধুরী বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন বিপ্লবী কর্মী যিনি বিপ্লবী সূর্য সেনের সহকর্মী ছিলেন। তিনি ১৯১১ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালি থানায় জন্মগ্রহণ করেন।

অনুপম সেন : ড. অনুপম সেন বাংলাদেশি সমাজবিজ্ঞানী। বর্তমানে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বে থাকা এই সমাজবিজ্ঞানী ২০১৪ সাল শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য একুশে পদকে ভূষিত হন। অনুপম সেন ১৯৪০ সালের ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম মহানগরীতে জন্মগ্রহণ করেন।

মুহাম্মদ ইউনূস : অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষক। তিনি ক্ষুদ্রঋণ ধারণার প্রবর্তক। অধ্যাপক ইউনূস প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। ইউনূস বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার সহ আরো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছেন। মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৪০ সালে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার বাথুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

সূর্য সেন : সূর্য সেন বা সূর্যকুমার সেন যিনি মাস্টারদা নামে সমধিক পরিচিত। তার ডাকনাম ছিল কালু। ভারতবর্ষের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিত্ব। সূর্য সেন ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম রাজমনি সেন এবং মায়ের নাম শশী বালা সেন।

আবুল কাসেম খান : আবুল কাশেম খান একজন রাজনীতিবিদ, আইন শাস্ত্রজ্ঞ, ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতি। তিনি সাধারণত একে খান হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৯০৫ সালের ৫ এপ্রিল চট্টগ্রাম শহরের চান্দগাঁও থানার মোহরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী : দেশপ্রম ও জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী ছিলেন অসীম সাহসী একজন রাজনীতিবিদ। তিনি ২৩ মার্চ ১৮৮৬ সালে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার বৈলছড়ী গ্রামে অভিজাত উজির বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।

আবদুল করিম : আবদুল করিম বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী উপজেলার চাপাছড়িতে।

সৈয়দ আহমদ উল্লাহ : সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী বা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ হলেন একজন সুফি সাধক ও মাইজভান্ডারী তরীকার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী নামেই বহুল পরিচিত। আহমদ উল্লাহ ১৮২৬ সালে ১৪ জানুয়ারি (১ম মাঘ, ১২৩৩ বাংলা সন) চট্টগ্রাম শহর হতে ৪০ কিলোমিটার উত্তরে তৎকালীন প্রত্যন্ত মাইজভান্ডার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

নুরুল ইসলাম : জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা চিকিৎসক, যিনি চিকিৎসাশাস্ত্র ও অধ্যাপনা জন্য বিশেষ খ্যাতিমান ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক দেশের জাতীয় অধ্যাপক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ডা. নুরুল ইসলামের জন্ম ১৯২৮ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ থানার মোহাস্মদপুর গ্রামে।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক স্তম্ভপ্রতিম কথাশিল্পী। কল্লোল যুগের ধারাবাহিকতায় তার আবির্ভাব হলেও তিনি ইউরোপীয় আধুনিকতায় পরিশ্রুত নতুন কথাসাহিত্য বলয়ের শিলান্যাস করেন। জগদীশ গুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের উত্তরসূরি এই কথাসাহিত্যিক অগ্রজদের কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করলেও বিষয়, কাঠামো ও ভাষা-ভঙ্গিতে নতুন এক ঘরানার জন্ম দিয়েছেন। তার জন্ম চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর এলাকায়, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট।

আবুল ফজল : আবুল ফজল বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং রাষ্ট্রপতির শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি মূলত একজন চিন্তাশীল ও সমাজমনস্ক প্রবন্ধকার। তার প্রবন্ধে সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্র সম্পর্কে গভীর ও স্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। আবুল ফজল ১৯০৩ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার কেঁওচিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন।

এ-ছাড়াও এ জেলায় জন্মগ্রহণকারী অন্যান্য প্রখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন :

আল্লামা এম. এ. মান্নান

আ জ ম নাছির উদ্দিন

এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী

আবদুল হক (বীর বিক্রম)

middle of post box 3

আবদুল করিম (বীর বিক্রম)

এম হারুন-অর-রশিদ (বীর প্রতীক)

আবদুল গফুর হালী

ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক

মুহাম্মদ ইব্রাহিম

ড.অছিয়র রহমান

প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী

আহমদ ছফা

আহমদ শরীফ

মাহবুব উল আলম চৌধুরী (কবি)

মাহাবুব উল আলম (সাহিত্যিক)

শাবানা

শাহ মুহম্মদ সগীর

শেফালী ঘোষ

শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব

আসকর আলী পন্ডিত

রমেশ শীল

সত্য সাহা

কুমার বিশ্বজিৎ (শিল্পী)

আইয়ুব বাচ্চু (শিল্পী)

তামিম ইকবাল (ক্রিকেটার)

আফতাব আহমেদ (ক্রিকেটার)

পার্থ বড়ুয়া (গায়ক)

সুকুমার বড়ুয়া (লেখক)

সুব্রত বড়ুয়া (লেখক)

সুজন বড়ুয়া (লেখক)

এছাড়াও আরো অনেক গুনি লোকের জন্মস্থান চট্টগ্রাম। যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখে দেশের উন্নতির জন্য কাজ করে গেছেন। তাদের কথা জাতি দীর্ঘদিন শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করবে। চট্টগ্রাম এর বিখ্যাত ১০টি স্থান: চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা, সীতাকুন্ড, চন্দ্রনাথ পহাড় ও মন্দির, নন্দনকানন, ওলি খাঁর মসজিদ, কোর্ট বিল্ডিং, জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর, আগ্রাবাদ, কদম মোবারক মসজিদ,ফয়েজ লেক।

লেখক : পিএইচ.ডি গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

after post box 2