সর্বশেষ

মিথ্যা, গুজব ও কুসংস্কার রোধে ইসলাম

114
Before post box 1

 

অধ্যাপক ড. মো. আবদুল কাদির :: মিথ্যা, গুজব ও কুসংস্কার তিনটি আলাদা বিষয় হলেও একটি আরেকটির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। ইসলামের দৃষ্টিতে মিথ্যা বলা বড় অপরাধ। গুজব তার চেয়েও ভয়াবহ। আর কুসংস্কার তৈরি হয় মিথ্যা, গুজব, অজ্ঞতা ও ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করেই। মানব প্রকৃতির এই তিন মন্দ দিক ইমান, আমল ও সমাজের সার্বিক ক্ষতির কারণ। তাই ইসলামে এই তিন কাজ করা কঠোরভাবে নিষেধ। মহানবী (সা.) নিজের জীবনে এই তিন অপরাধের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন এবং সমাজকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার সংগ্রাম করেছেন। এখানে আমরা কোরআন-হাদিসের আলোকে প্রতিটি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করছি।

মিথ্যা সব গুনাহের মূল : মানব চরিত্রের মারাত্মক এক ব্যাধির নাম মিথ্যা বলা। এটি সব গুনাহের মূল। সমাজের সব ফিতনা ও বিপর্যয়ের মূলে থাকে মিথ্যা। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে মিথ্যা বলা কবিরা গুনাহ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা এ ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। এরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা মিথ্যা কথা পরিহার করো।’ (সুরা হজ: ৩০) অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারী ও মিথ্যাবাদীকে সৎপথে পরিচালিত করেন না।’ (সুরা গাফির: ২৮) মিথ্যা সব পাপের দরজা খুলে দেয়। মিথ্যা মানুষকে জাহান্নামের দিকে টেনে নেয়। তাই অপরাধ ও পাপ কাজ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হলে মিথ্যা বলার অভ্যাস ছাড়তে হবে। সমাজের সব স্তরে মিথ্যার প্রবণতা কমাতে হবে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা মিথ্যা থেকে দূরে থেকো। কেননা মিথ্যা মানুষকে পাপাচার পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। আর পাপাচার জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। ব্যক্তি যখন অনবরত মিথ্যা বলতে থাকে, তখন আল্লাহর কাছে তাকে মিথ্যাবাদী হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়।’ (বুখারি ও মুসলিম) একটি কথা মনে রাখতে হবে, ‘সত্য মুক্তি দেয় এবং মিথ্যা ধ্বংস করে।’

গুজব মিথ্যার চরম পর্যায় : গুজব অর্থ রটনা। এমন কথা ছড়ানো, যার কোনো সত্যতা নেই। বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বিশেষ কোনো গোষ্ঠী সমাজে গুজব ছড়ায় এবং মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করে। পাশাপাশি এটি ফেতনা ও জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করে। এমনকি অনেক সময় গুজবের কারণে বড় দুর্ঘটনা ঘটে এবং সমাজ বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তাই গুজব মিথ্যার চরম পর্যায়। বর্তমান যুগে তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের কারণে এ কাজটি খুবই সহজ হয়ে গেছে। অথচ গুজব ছড়ানো ইসলামের দৃষ্টিতে কবিরা গুনাহ।

উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা ছড়ানো তো গুরুতর অপরাধই, এমনকি কোনো সংবাদ যাচাই-বাচাই ছাড়া প্রচার করাও ইসলামের দৃষ্টিতে কঠিন অপরাধ। সরল মনে কোনো কথা শুনেই প্রচার করে দেওয়া মিথ্যা বলার শামিল। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ, যদি কোনো ফাসিক তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে। এ আশঙ্কায় যে তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো সম্প্রদায়কে আক্রমণ করে বসবে। ফলে তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে।’ (সুরা হুজরাত: ৬) হাদিসে মহানবী (সা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট, সে যা শুনতে পায়, (সত্যতা যাচাই না করে) তা-ই বলে বেড়ায়।’ (মুসলিম)

middle of post box 3

সব কাজের কৈফিয়ত রোজ হাশরে আল্লাহর কাছে দিতে হবে। তিনি আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেক দিয়েছেন। সুতরাং গুজব ছড়ানোর মানেই হলো, আল্লাহ তাআলার দেওয়া এসব নেয়ামতের সঠিক ব্যবহার না করা। যেমনটি পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ কোরো না। অবশ্যই কান, চোখ ও হৃদয়—এগুলোর ব্যাপারে (কিয়ামতের দিন) কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ (সুরা ইসরা: ৩৬)

কুসংস্কার কুফরির পথ খুলে দেয় : কুসংস্কার হলো এমন কাজ, কথা ও প্রথা; বাস্তবতা ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যার কোনো ভিত্তি নেই। মানুষের তৈরি যুক্তিহীন ভ্রান্ত বিশ্বাস, কথা, কাজ ও প্রথাকে ইসলামের দৃষ্টিতে কুসংস্কার বলে। কুসংস্কারের কারণে মানুষের জীবনও হুমকির মুখে পড়ে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আগমনের আগের যুগকে পবিত্র কোরআনে জাহিলি যুগ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কারণ সেকালের আরবসমাজ বিভিন্ন কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। এসব কুসংস্কার থেকে সমাজকে শুদ্ধ করার জন্যই আল্লাহ তাআলা মহানবী (সা.)-কে পাঠিয়েছেন।

আল্লাহ তাআলা ছাড়া কাউকে শক্তির উৎস মনে করা কুফরি। অথচ কুসংস্কার এমন ধারণাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো কিছুকে কার্যসম্পাদনের কারণ মনে করা শিরকেরই পর্যায়ভুক্ত। যেমন মানুষের ভ্রান্ত বিশ্বাস রয়েছে যে ব্যাঙ ডাকলে বৃষ্টি হয়, কালো বিড়াল বা প্যাঁচা দেখা দুর্ভাগ্যের লক্ষণ, কাক ডাকলে মৃত্যু আসে, জোড়া কলা খেলে যমজ বাচ্চা হয়, হাতের তালু চুলকালে টাকা আসে ইত্যাদি। এগুলো অজ্ঞতা, মূর্খতা ও অন্ধ আনুগত্যের ফসল। প্রকৃত মুমিন কখনোই এসব বিশ্বাস করতে পারে না। কারণ আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তিনিই বাদশাহ, মহা পবিত্র, ত্রুটিমুক্ত, নিরাপত্তাদানকারী, মহা পরাক্রমশালী, মহা প্রতাপশালী ও অতি মহিমান্বিত। তারা যা শরিক করে, তা থেকে তিনি পবিত্র।’ (সুরা হাশর: ৩৩)

কুসংস্কারের সঙ্গে ইসলামের দূরতম সম্পর্কও নেই। হাদিসে মহানবী (সা.) বলেন, ‘কোনো কিছুকে অশুভ, অপয়া মনে করা শিরক।’ (আল আদাবুল মুফরাদ) রাসুলুল্লাহ (সা.) বিদায় হজের ভাষণে কুসংস্কারের মূলে কুঠারাঘাত করে দীপ্ত কণ্ঠে বলেন, ‘জাহিলি যুগের সব কুসংস্কার আমার পায়ের নিচে নিক্ষেপ করা হলো।’ (ইবনে মাজাহ)

লেখক: চেয়ারম্যান, আরবি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

after post box 2