সর্বশেষ

আরাকান ঘিরে মিয়ানমার, চীন ও ভারতের জটিল সমীকরণ -অধ্যাপক শাব্বির আহমদ

195
Before post box 1

নিউজটিভিবিডি ডেস্ক :: বিশ্ব রাজনীতিতে আবার আলোচনায় এসেছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। এবারে অবশ্য আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রোহিঙ্গা মুসলিমরা নয়; রাখাইন জাতীয়তাবাদী ‘আরাকান আর্মি’ সংক্ষেপে ‘এএ’। ২০ হাজার বর্গমাইল এলাকা জুড়ে অবস্থিত আরাকান এর উত্তরে মিয়ানমারের চিন স্টেট, ম্যাগওয়ে রিজিয়ন, বাগো রিজিয়ন, পূর্বে ইরাবতি অঞ্চল, পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর ও উত্তর-পশ্চিমে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অবস্থিত। আরাকান আর্মি এবং তাদের রাজনৈতিক শাখা অতীতের সমৃদ্ধ আরাকান রাজ্যের স্মৃতিচারণ করে আরাকানীদের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখায়। রাখাইনরা থেরোবাদী বৌদ্ধ মগ। মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের বৌদ্ধদের থেকে তারা আলাদা। এএ মনে করে, আরাকান পর্বতমালা (ইয়োমা) দ্বারা এটি মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ড থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মিয়ানমার ১৭৮৪ সাল থেকে জোরপূর্বক আরাকানকে দখল করে রেখেছে এবং তারা ঔপনিবেশিক শক্তি। মিয়ানমার বাহিনীর বিরুদ্ধে আরাকানের রাখাইনরা লড়াই করলেও দুই পক্ষের মধ্যে একটি বিষয়ে মিল রয়েছে। তা হলো- দুই পক্ষের কেউই রোহিঙ্গাদের আরাকানের মূল জাতিসত্বার অংশ মনে করে না। মূলত আরাকানি বৌদ্ধ রাখাইন মগদের হাতে রোহিঙ্গা মুসলিমরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে। ২০১২ সালের দাঙ্গা সৃষ্টি করেছিল তারাই। রোহিঙ্গারা যাতে মিয়ানমারের নাগরিক অধিকার না পেতে পারে, সে জন্য তারা জোরালো আন্দোলন করে আসছে দশকের পর দশক। তাদের দাবি, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, তারা বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী দেয়, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও তাদের পরিচয়কে ঘিরে আরাকানের রাজনীতি ও সভ্যতা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আবর্তিত হয়েছিল। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে কয়টি এলাকায় মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে; এমনকি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়; আরাকান তার মধ্যে অন্যতম। রোহিঙ্গারা সেই আরাকানি মুসলমানের বংশধর। আজকের আলোচনা যেহেতু ভিন্ন প্রসঙ্গ সুতরাং অন্য সময় এতদবিষয়ে আলোচনা করবো।

এএ আরাকানভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন হলেও এদের ক্যাডারদের অবস্থান মুখ্যত কাচিন এলাকায়। সেখানে লাইজা অঞ্চলে তাদের সদর দপ্তর। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সামনে শক্ত চ্যালেঞ্জ নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে গোষ্ঠীটি। রাখাইনের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলেই শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে তাদের।এছাড়া বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে নিজেদের অভয়রাজ্য গড়ে তুলেছে। অনেক এলাকায় গড়ে তুলেছে নিজস্ব শাসনব্যবস্থা। তবে প্রধান সংঘর্ষস্থল হলো চিন স্টেটের পালিতওয়া। বান্দরবান সন্নিহিত কালাদন নদীর পাড়ের এই স্থান বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার সংযোগস্থল হিসেবে পরিচিত। বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নে তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমার থেকে আসা মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা মূলত মিয়ানমার সেনা ও বিদ্রোহী আরাকান আর্মির মধ্যকার সংর্ষের ঘটনা থেকেই।
২০০৯ সালে তরুণ ছাত্র নেতা তোয়ান ম্রেট নায়েং মাত্র ২৯ জন নিয়ে গড়ে ওঠা আরাকান আর্মি দিন দিন অপ্রতিরোদ্ধ হয়ে উঠছে। রাখাইন জনগোষ্ঠীর মাঝে রয়েছে তাদের তুমুর জনপ্রিয়তা। বর্তমানে তাদের ১০ হাজার সক্রিয় যোদ্ধা রয়েছে। সাথে রয়েছে তাদের রাজনৈতিক উইং ‘ইউনাইটেড লীগ ফর আরাকান’ (ইউএলএ)। উল্লেখ্য, এএ হলো মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলের অপর গেরিলা গ্রুপ ‘আরাকান লিবারেশন আর্মি’ বা ‘এএলএ’র থেকে পৃথক একটি সংগঠন। এএলএ হলো আরাকানের সবচেয়ে প্রাচীন গেরিলা দল। বর্তমানে মিয়ানমার সরকারের সাথে তাদের যুদ্ধবিরতি চলছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা নিধনাভিযানে এএলএর ভূমিকা ছিল সহায়কের। যদিও গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের পূর্বে এএলএ এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি সংস্থা (আরএসও) একই সঙ্গে আরাকানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংগ্রাম করেছে।

জাতিগত সংঘাত, সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম ছাড়াও ভূকৌশলগত কারণেও রাখাইন রাজ্যটি বর্তমানে প্রতিবেশী চীন-ভারত ও বহির্বিশ্বে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে। বিশ্ব থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্ন বার্মায় চীনের রয়েছে বিরাট রাজনৈতিক প্রভাব ও বিনিয়োগ। চীন রাখাইনের কিউকফিউতে গভীর সমুদ্র বন্দর, সিনো-মিয়ানমার তেল-গ্যাস পাইপলাইন ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে। বেইজিং মালাক্কার ঝুঁকিপূর্ণ প্রণালী পরিহার করে বিকল্প জ্বালানি রোড হিসেবে বেছে নেয় রাখাইন উপকূলের কিউকফিউ থেকে চীনের ইউনান পর্যন্ত সরাসরি জ্বালানি পাইপলাইন স্থাপন প্রকল্প। এই পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের পথে। এতদসত্বেও দেশ দু’টোর মধ্যে সম্পর্ক বেশ কৌশলী ও জটিল। চীন বহু জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত মিয়ানমারের মিয়ানমারের সামরিক ও বেসামরিক সরকারের সাথে সম্পর্ক রাখার পাশাপাশি বিচ্ছিন্নতাবাদী এথনিক সশস্ত্র গোষ্ঠিদেরও পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। মিয়ানমারের সবচেয়ে শক্তিশালী ও বৃহৎ এথনিক আর্মি দ্য ইউনাইটেড ওয়া স্টেইট আর্মি, আরাকান আর্মি, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মিসহ বেশ কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন চীনের কাছ থেকে অর্থ, অস্ত্র ও আশ্রয় পায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এথনিক আর্মিদের বেইজিং মূলত নেপিডো-র (মিয়ানমারের রাজধানী) সাথে ‘বার্গেইনিং চিপ’ হিসেবে ব্যবহার করে। মিয়ানমার চীনের এরকম পন্থা মোকাবেলায় ও একচ্ছত্র কর্তৃত্ব নিয়ন্ত্রণ করতে ভারত, রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।

ভারত প্রাথমিকভাবে মিয়ানমারের সামরিক সরকারগুলোর সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় স্বস্তি বোধ না করলেও পরে গণতন্ত্র স্বৈরতন্ত্র বাছবিচার না করে বর্মি সরকারের সাথে বিশেষ সম্পর্ক সৃষ্টি করে। মিয়ানমারের সরকার এককভাবে চীনা নির্ভরতা থেকে কিছুটা বের হয়ে বহুপক্ষীয় নির্ভরতার সুযোগ গ্রহণ করে। আর ভারতের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে ওঠে বৃহত্তর আসামের রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের সাথে বঙ্গোপসাগরের সংযোগ তৈরি। এ জন্য মিয়ানমারের রাখাইন উপকূলের সিটওয়ে থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতের পালেতোয়া হয়ে মেঘালয়ের আইজল পর্যন্ত সরাসরি সংযোগের জন্য কালানদান রিভার প্রকল্প গ্রহণ করে। সীমান্ত নিয়ে চীনের সাথে ভারতের বিরোধ দীর্ঘদিনের। ভারতের আকসাই চিন অঞ্চল ও অরুণাচল প্রদেশকে চীন নিজেদের এলাকা মনে করে। সেকারণে ভারত লাদাখ ও সেভেন সিস্টার্স নিয়ে চরম নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকে। এ ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে থাকা শিলিগুড়ি করিডোর। ৬০ কি.মি. লম্বা ও ২২ কি.মি. প্রস্থের সরু এ করিডোরটি ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে সেভেন সিস্টার্সে যোগাযোগের একমাত্র পথ। চীনের দোকলাম থেকে যার দূরত্ব মাত্র ১৩০ কি.মি.। দুর্যোগপূর্ণ সময়ে চীনের চুম্বী ভ্যালিতে মোতায়েন থাকা সেনা দল শিলিগুড়ি করিডোর নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলে পুরো সেভেন সিস্টার্স ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। নিরাপত্তা ও যোগাযোগের কথা চিন্তা করে ভারত কালাদান প্রকল্পের মাধ্যমে সেভেন সিস্টার্সে প্রবেশের বিকল্প পথ তৈরিতে উদ্যোগী হয়। কালাদান মাল্টি মডেল ট্রানজিট প্রকল্পটি মূলত কলকাতা হলদিয়া বন্দর থেকে আরাকানের সিতওয়ে বন্দর পর্যন্ত ৫৩৯ কি.মি. সমুদ্র পথ, সিতওয়ে বন্দর থেকে কালাদান নদী বেয়ে মিয়ানমারের চিন রাজ্যের পালেতোয়া শহর পর্যন্ত ১৫৮ কি.মি. নৌপথ পথ, সেখান থেকে মিজোরাম রাজ্যের আইজাওয়াল পর্যন্ত ১৯৭ কি.মি. সড়ক পথ। প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে কলকাতা থেকে আইজাওয়াল পৌঁছাতে মাত্র ৮৯৫ কি.মি. পথ পাড়ি দিতে হবে। বর্তমানে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি করিডোর দিয়ে মিজোরামের আইজাল শহরে পৌঁছাতে ১৮৮০ কি.মি. পথ পাড়ি দিতে হয়। ধারণা করা হচ্ছে, আরাকানের পরিবেশ শান্ত থাকলে ২০২৩ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হবে।

আরও পড়ুন

মহান বিজয় দিবস ও আমাদের প্রত্যাশা

বিশ্ব ব্যাংকে চাকরি, নিয়োগ বাংলাদেশে

middle of post box 3

ভারত ও চীন উভয়েই রাখাইন রাজ্যের ওপর দিয়ে অর্থনৈতিক করিডোর স্থাপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একসময় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতো। ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর পরিচালিত গণহত্যা, শুদ্ধি অভিযান এবং দশ লক্ষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার পেছনে চীন-ভারতের উপরোক্ত মনোভাবও অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করেছিল বলে অনেকে মনে করে থাকেন। বাংলাদেশের সাথে চীন-ভারতের অতি ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সম্পর্ক থাকলেও কোনো দেশই রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরানোর ব্যাপারে বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি। অধিকন্তু, বৈশ্বিক ফোরামে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এই দুই দেশ হয় সরাসরি বাংলাদেশের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে, নয়তো ভোট দানে বিরত থেকেছে।

২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিপুল সংখ্যায় বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার সময় আরাকান আর্মি (এএ) মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে সহায়তা করলেও কিছুদিনের মাথায় তাদের সামরিক কৌশলে পরিবর্তন এনে মিয়ানমারের সেনার বিরুদ্ধে আগ্রাসী অবস্থান নেয় আরাকান আর্মি। বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের বসতি এলাকায় রাখাইন জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন পরোক্ষভাবে এএ’কে লাভবান করে। বৃহৎ রাখাইন জনগোষ্ঠীর সমর্থনপুষ্ট আরাকান আর্মি তাদের রাজ্যে চীন ও ভারতের বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়নকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে। তাদের অভিযোগ, নেইপিডো’র সামরিক জান্তার যোগসাজশে এসব বিদেশী প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে মূলত রাখাইনের প্রাকৃতিক সম্পদ কুক্ষিগত করার জন্য। আবার এর সাথে যোগ হয় আন্তর্জাতিক নানা সমীকরণও। অনেক আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক মনে করেন,আরাকান ইয়োমা বা আরাকান পর্বতমালা, যা মায়ানমারের মূল ভূখন্ড থেকে আরাকানকে পৃথক করেছে তা দক্ষিণ থেকে উত্তরে বিস্তৃত। দক্ষিণে মিয়ানমারের নেগ্রাইস অন্তরীপ থেকে শুরু হয়ে এটি উত্তরে প্রায় ৯৫০ কিলোমিটার প্রসারিত হয়ে ভারতের অঙ্গরাজ্য মণিপুর পর্যন্ত চলে গেছে; এর মধ্যে নাগা, চিন, লুসাই এবং পাটকাই পাহাড় অন্তর্গত। এসব পর্বতমালা ও পর্বতশ্রেণীতে সেভেন সিস্টার্সখ্যাত ভারতের সাতটি পাহাড়ী রাজ্য অবস্থিত। মায়ানমারের চিন, কাচিন ও আরাকানজুড়ে বসবাসকারী নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সাথে ভারতের সেভেন সিস্টারের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর রয়েছে ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগত সম্পর্ক। দীর্ঘদিন ধরে খ্রিস্টান মিশনারীদের তৎপরতায় এসব নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বিরাট একটি অংশ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। ভারতের সেভেন সিস্টার, উত্তর-পূর্ব মিয়ানমারের কয়েকটি প্রদেশ ও পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে জুমল্যান্ড নামে স্বাধীন খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা পশ্চিমা বিশ্বের দীর্ঘদিনের। মায়ানমারের চিন, কাচিন ও আরাকান রাজ্য স্বাধীন করে দিতে পারলে তাদের জুমল্যান্ড প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন একধাপ এগিয়ে যাবে। মায়ানমারের চিন, কাচিন ও আরাকান রাজ্যেজুড়ে চলমান বিচ্ছিন্ন সশস্ত্র সংগ্রামে পশ্চিমাদের মদদ রয়েছে বলে অনেক আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক মনে করেন।

যার ফলে রাখাইন রাজ্যকে ঘিরে মিয়ানমার ও চীন- ভারতের পূর্ব পরিকল্পনায় দেখা দেয় নতুন সংকট। রাখাইন রাজ্যে চীন তাদের বিভিন্ন প্রকল্প সাবলীলভাবে যাতে বাস্তবায়ন করতে না পারে, সে জন্য পাশ্চাত্যের নানা স্থান থেকে অস্থিতিশীলতায় ইন্ধন দেয়া হচ্ছে অভিযোগ বেইজিং এর। একই অভিযোগ ভারতের পক্ষ হতেও। ভারতসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমও দাবি করছে বেইজিং জমি রেভ্যুলুশনারী আর্মি, উলফা, এনএসসিএন সহ বেশ কয়েকটি বিদ্রোহী গ্রুপকে অস্ত্র দিয়ে সংগঠিত করার চেষ্টা করছে। এ থেকে ধারণা করা যায়, চীন প্রয়োজনে আরাকানকে ভারতের জন্য বেশ জটিল করে তুলবে। ভারতের সাথে আরাকানিদের নিকট অতীতের সম্পর্ক সুখকর নয়। এর মূল কারণ হচ্ছে দিল্লীর সাথে নেপিডো জেনারেলদের সুসম্পর্ক। নেপিডোর অনুরোধে ভারতীয় সেনারা আরাকানি বিদ্রোহীদের কখনো রাজনৈতিক বা সামরিকভাবে দাঁড়ানোর সুযোগ দেয়নি। ২০১৫ সাল থেকে ভারত ও মিয়ানমারের সেনারা আরাকান আর্মির ওপর একের পর এক সমন্বিত আক্রমণ চালিয়ে আসছে। ২০১৮-১৯ সালে মিয়ানমার সরকারের অনুরোধ ভারতীয় সেনারা মিজোরামে আরাকান আর্মির ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে ও সব ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়। তার প্রতিদান হিসেবে মিয়ানমারের সেনারা সাগাইং প্রদেশে ভারতের নাগা, মিজো ও আসামীয়া বিদ্রোহীদের ওপর আক্রমণ চালায়। আরাকান আর্মি ২০১৯ সালের নভেম্বরে কালাদান প্রকল্পের ৫ জন ভারতীয় কর্মীকে অপহরণ করে এবং নয়া দিল্লীকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়- আরাকানে কালাদান প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে তাদের কর দিতে হবে। আরাকান আর্মি কালাদান প্রকল্পের কাজে বাধা দেয়, কিন্তু কিয়াকফিউতে চীনের কোন কাজে দেয়না, এ নিয়ে আরাকান আর্মিকে প্রশ্ন করলে তারা বেশ খোলামেলাভাবে বলে, ‘চীন আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে, ভারত দেয়নি। সুতরাং এ থেকে ধারণা করা যায়, ভবিষ্যতে আরাকান আর্মি ভারতের সাথে কঠিন দরকষাকষি করবে। রাখাইন রাজ্য ঘিরে ভারতের আরেক ভয় হচ্ছে, সেভেন সিস্টার্স এর কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ভারতকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম- ইন্ডিপেন্ডেন্ট (উলফা) ও ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ডের (এনএসসিএন) মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত। তারা মিয়ানমারের ভেতর থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। এমতাবস্থায় প্রতিবেশী রাজ্য রাখাইন স্বাধীন হলে সেই স্বাধীনতার ঢেউ সেভেন সিস্টার্সখ্যাত রাজ্যগুলোতেও আছড়ে পড়তে পারে- এই আশঙ্কা ভারতীয় নীতিনির্ধারণী মহল সবসময় পোষণ করেন

সব মিলিয়ে বলা যায়, আরাকানসহ উত্তর-পূর্ব মিয়ানমারে যে সংঘাত শুরু হয়েছে তার শেষ কোথায় এই মুহুর্তে বলা মুশকিল। তবে, এই অঞ্চলে অস্থির পরিস্থিতির রাশ টেনে ধরতে না পারলে চীন-ভারতের বিশাল বিনিয়োগ যেমন ধূলোয় মিশে যাবে, তেমনি প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে ফেলে দিয়েছে গভীর উদ্বেগ-উৎকন্ঠায়।

অধ্যাপক শাব্বির আহমদ
শিক্ষক, কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক।

after post box 2